নির্মাণশৈলী
ভূমিকম্পে স্থাপনা রক্ষায় 'কাঠ কুনি'র জাদু
ভারতের হিমাচলে কাঠ কুনি পদ্ধতিতে নির্মিত নাগার দুর্গ -বিবিসি
আবদুস সামাদ আজাদ
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ | ১৩:৫৮
ভারতের হিমাচল প্রদেশে ১৯০৫ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কংক্রিটের স্থাপনাসহ অনেক বাড়ি ভেঙে পড়েছিল তাসের ঘরের মতো। তবে দিব্যি টিকে ছিল ৫০০ বছরের পুরোনো 'নাগার দুর্গ'। এটি কাঠ কুনি শৈলীতে নির্মিত। দুর্গটি এই অঞ্চলের কুল্লু রাজাদের জন্য তৈরি হয়েছিল। ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের কর্মকর্তারা অক্ষত দুর্গটি পরিদর্শন করে অবাক হন। তবে শুধু এটিই নয়, কাঠ কুনি পদ্ধতিতে নির্মিত অন্য স্থাপনাগুলোও রক্ষা পেয়েছিল।
ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি 'কাঠ কুনি'। ভূমিকম্প প্রতিরোধে এই নির্মাণশৈলী জাদুর মতো কাজ করে। তবে কাঠ কুনির ঘরবাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। অল্প কিছু স্থাপনা এখনও চোখে পড়ে হিমাচলে। এই শৈলী হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতা ও খরচ বেশি। এ কারণে স্থানীয়রা কংক্রিটের ঘর নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে।
ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের কর্মকর্তারা প্রথমে মনে করেছিলেন, অপেক্ষাকৃত ভারী দেয়ালের কারণে হয়তো ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি নাগার দুর্গ। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। তারা লক্ষ্য করলেন, কাঠের বন্ধনযুক্ত দেয়ালে প্রাকৃতিকভাবে কম্পন প্রতিরোধী শক্তি রয়েছে। এ কারণে প্রবল ভূমিকম্পেও স্থাপনাটি টিকে গেছে। কাঠ কুনিতে মূলত কাঠের টুকরো ও গুঁড়া এবং ছোট পাথর ব্যবহার হয়। কাঠের কুনিগুলো দেবদারু গাছ থেকে তৈরি হয়, আর ব্যবহার হয় স্থানীয় নুড়ি পাথর। এই নির্মাণশৈলীতে দ্বিস্তরবিশিষ্ট দেওয়াল তৈরি করা যায়, যা নান্দনিক নকশার জন্য বিখ্যাত। এই নকশা দেয়ালের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। কাঠের গুঁড়ার মিশ্রণ সিমেন্টিং উপাদান হিসেবে কাজ করে। পাথরগুলো কাঠামোকে ভারি করে এবং কাঠের নমনীয়তা কাঠামোটিকে ধরে রাখতে সহায়তা করে। এই শৈলী হিমালয় অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভবনের দরজা ও জানালাগুলো ছোট আকারের হওয়ায় চাপ কম থাকে এবং পুরু স্লেটের ছাদ গোটা ভবনকে শক্তভাবে ধরে রাখে।
'কাঠ কুনি' নাম সংস্কৃত থেকে এসেছে। এর অর্থ হলো কাঠের টুকরো। কাঠ কুনির রাজমিস্ত্রি এখনও হিমাচলে আছেন। তাঁদের একজন তেধি সিং। তিনি বলেন, চেহনি গ্রামের বাড়িগুলো এখন এই নির্মাণশৈলীর সাক্ষী। অন্যান্য গ্রামের তুলনায় এখানকার বাড়িগুলোর নকশায় চোখ আটকে যাবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, কাঠের বিমগুলো একত্রে আটকানো রয়েছে। দেয়ালের স্তরগুলোর মধ্যে পাথর ও কাঠের টুকরোর অবস্থান ভূমিকম্পে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করে।
তেধি সিং বলেন, কাঠ কুনি কাঠামোয় রয়েছে দ্বিস্তরবিশিষ্ট দেয়াল, যা ঘরকে শীতের দিনে উষ্ণ ও গরমের দিনে ঠান্ডা রাখে। পানি ও বরফ দেয়ালের গা দিয়ে ঢুকতে পারে না। এই স্থাপত্য কৌশলটি স্থানীয় কৃষি ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
হিমাচলের ছোট গ্রাম চাচোগি। এখানে মোহিনী তাঁর স্বামী ও মেয়ের সঙ্গে থাকেন একটি প্রাচীন কাঠ কুনির ঘরে। তিনি বলেন, ঘরে সাধারণত নিচতলায় গবাদি পশু থাকে এবং ওপরের তলায় মানুষ। কংক্রিটের ঘর তাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খায় না। গবাদি পশুর আরামদায়ক বসবাসের কথাও ভাবতে হয়। তিনি মনে করেন, ভূমিকম্প হলে বাড়িটি এখনও ভাঙবে না।
১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ শাসকদের কুদৃষ্টি পড়ে এই নির্মাণশৈলীর ওপর। তারা ঘর নির্মাণে দেবদারু কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। স্থানীয়দের কাছ থেকে বনের মালিকানা চলে যায় সরকারের হাতে। ২০০৬ সালে ভারত সরকার বন অধিকার আইন পাস করে। এই আইন প্রতি পরিবারকে ১০ বছরে মাত্র একটি গাছ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তবে একটি গাছ থেকে যে কাঠ পাওয়া যায়, তা ঘর তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়।
হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অব কালচারাল অ্যান্ড হেরিটেড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সোনালী গুপ্তা বলেন, স্থানীয়রা এখনও কাঠের ঘর নির্মাণ করতে চায়; কিন্তু প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করা এখন অত্যন্ত কঠিন। এতে খরচ কংক্রিটের ঘরের চেয়ে অনেক বেশি।
এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও চ্যালেঞ্জ নিয়ে স্থানীয় সংস্থাগুলো কাঠ কুনির পক্ষে প্রচারাভিযান চালায়। এরকম একটি সংস্থা 'নর্থ'। সংস্থাটি গ্রাহকদের কাঠ কুনি শৈলীতে ঘর নির্মাণে উৎসাহ দেয়। এ ক্ষেত্রে কারিগরদের সহায়তাও তারা করে থাকে। কাঠের বদলে কাঠ কুনিতে বাঁশের ব্যবহার করা যায় কিনা- তা নিয়েও কাজ করছে সংস্থাটি। সূত্র বিবিসি।
- বিষয় :
- নির্মাণশৈলী
- 'কাঠ কুনি'র জাদু