গুজরাটে জাতিগত নিধনে দায়ী মোদি

সমকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৩:৩০
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে কাজে লাগিয়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলমানদের জাতিগত নিধন এবং মুসলিম নারীদের পরিকল্পিত ধর্ষণ করা হয়েছিল। মোদি দাঙ্গা থামাননি। বরং দাঙ্গা রোখার চেষ্টাকারীদের শায়েস্তা করেন।
বিবিসির 'ইন্ডিয়া : দ্য মোদি কোয়েশ্চেন' তথ্যচিত্রে অভিযোগগুলো ফের এসেছে। তবে এসব অভিযোগ নতুন নয়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মোদিকে নির্দোষ ঘোষণা করলেও ২১ বছর ধরেই মোদিকে দায়ী করা হচ্ছে গুজরাট দাঙ্গার জন্য। বিবিসির তথ্যচিত্রে নতুন যে তথ্যটি এসেছে, তা হলো যুক্তরাজ্য দাঙ্গার গোপন তদন্ত করেছিল। অপ্রকাশিত প্রতিবেদনে মোদিকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে সম্প্রচারিত এই তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার, ঔপনিবেশিক মানসিকতার উদাহরণ আখ্যা দিয়েছে ভারত সরকার। যদিও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সংসদে জানিয়েছেন, তথ্যচিত্রে যেভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তুলে ধরা হয়েছে এর সঙ্গে তিনি একমত নন।
কংগ্রেসসহ ভারতের বিরোধী দলগুলো নীরব থাকলেও সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমগুলো বিবিসির তথ্যচিত্রের সত্যতা নাকচ করে পাল্টা আক্রমণ করেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও তথ্যচিত্র বিষয়ে খুব বেশি খবর নেই। বিজেপি-আরএসএসের 'ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান খোলার' ঘোষণা দিয়ে হিন্দু-মুসলিম একতার জন্য ৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ 'ভারত জোড়ো যাত্রা' পদযাত্রায় নামা রাহুল গান্ধীও নিশ্চুপ। তৃণমূল কংগ্রেসসহ বাকি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোও নীরব।
আগামী ২৪ জানুয়ারি তথ্যচিত্রের দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হবে। উপমহাদেশের দর্শকরা ৫৯ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রথম পর্বটি দেখতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর বিভিন্ন অংশ ছড়িয়ে পড়েছে। বিজেপি সমর্থক ও সমালোচকদের তীব্র বিতর্ক চলছে।
গুজরাট দাঙ্গা : আলজাজিরার প্রতিবেদনে টুইটারে শেয়ার হওয়া একাংশ তুলে ধরা হয়েছে। এতে ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্রয়ের সাক্ষাৎকার রয়েছে। প্রথমবারের মতো এ বিষয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারণে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একটি দল গঠন করা হয়েছিল, যারা গুজরাটে গিয়ে দাঙ্গার তদন্ত স্বাধীনভাবে করে।
তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, প্রতিবেদনটি কখনও প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু প্রতিবেদনে যে পরিমাণ হতাহতের তথ্য এসেছে, প্রকৃত অবস্থা ছিল তার চেয়েও ভয়ংকর। মুসলিম নারীদের ব্যাপক ও পরিকল্পিত ধর্ষণ করা হয়েছিল। হিন্দুপ্রধান এলাকা থেকে মুসলিমদের উৎখাতে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। জাতিগত নিধন চালানো হয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে।
২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গুজরাটের গোধারায় অযোধ্যাফেরত করসেবকবাহী ট্রেন 'সবরমতি এক্সপ্রেস'-এ আগুন লাগে। এতে ৫৮ জন হিন্দু তীর্থযাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এ অগ্নিকাে হমেদাবাদে আনলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ভারত সরকারের হিসাবে এতে ১ হাজার ৪৪ জন নিহত হন। যাঁদের ৭৯০ জন মুসলমান। তবে বেসরকারি সংখ্যা আরও বেশি।
কী আছে তথ্যচিত্রে :গুজরাটের দাঙ্গাকে ব্যবহার করে ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থেকে ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন মোদি। তাঁর দল বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘসহ (আরএসএস) বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং ভারতের বিচারব্যবস্থা তাঁকে সহায়তা করেছে।
যুক্তরাজ্যের তদন্তকারী দলের এক সদস্যের নাম বা ছবি প্রকাশ না করার শর্তে তাঁর বরাতে তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, মুসলমান সমাজকে পরিকল্পনামাফিক আক্রমণ করা হয়েছিল। হামলার নেতৃত্বে ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি)। সংগঠনটি মোদির নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের সহায়তা ছাড়া দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিতে পারত না। মোদি সরাসরি দায়ী।
বিজেপির স্থানীয় নেতাদের যাঁরা দাঙ্গায় ছিলেন, তাঁদের কয়েকজন বলেছেন, কীভাবে হত্যা করেছেন বা অন্যদের দিয়ে করিয়েছেন। তবে বিজেপির সবাই দাঙ্গার পক্ষে ছিলেন না, সে কথাও এসেছে তথ্যচিত্রে। ২০০২ সালে গুজরাটে মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন হরেণ পান্ডিয়া। যিনি দাঙ্গা থামাতে তৎপর ছিলেন। দাঙ্গা উস্কে দেওয়ার জন্য মোদিকে দায়ী করে মন্ত্রিসভায় কথা বলেন তিনি। ২০০২ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। ২০০৩ সালের মার্চে প্রাতঃভ্রমণে আততায়ীর গুলিতে খুন হন। যার বিচার আজও হয়নি।
গুজরাটের সেই সময়কার পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে মুখ্যমন্ত্রী মোদির ভূমিকায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁরা দাঙ্গা রুখতে অনুরোধ করেছিলেন। পুলিশ সুপার (এসপি) সঞ্জীব ভাট ছিলেন তাঁদের একজন। তিনি হরেণ পান্ডিয়াকে নিরাপত্তা হুমকির কথা জানিয়ে সতর্কও করেছিলেন। মোদি মুসলিমবিরোধী বক্তব্য কেন্দ্রীয় কমিশনকে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে পুলিশ হেফাজতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর মামলায় ২০১২ সালে সঞ্জীব ভাটকে যাবজ্জীবন কারাদ দেওয়া হয়। ২০০২ সালের পর তাঁকে ধারাবাহিকভাবে হেনস্তা করেছে মোদি সরকার- তা এসেছে তথ্যচিত্রে।
দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত এবং বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার রয়েছে। তাঁদের জবানিতে বলা হয়েছে, প্রথম তিন দিনে চুপচাপ ছিলেন মোদি। আক্রান্তদের রক্ষায় কিছুই করেননি। দাঙ্গার সময় গুজরাটে থাকা বিবিসির তৎকালীন সাংবাদিক জিল ম্যাকগিভারিংকে সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছিলেন, 'গণমাধ্যমকে বেশি জায়গা দিয়েছিলাম, সেটাই ছিল আমার একমাত্র ভুল।'
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি তথ্যচিত্রের কড়া সমালোচনা করেছেন। একে পক্ষপাতদুষ্ট আখ্যা দিয়েছেন- এমন একপেশে কথিত তথ্যচিত্রের গুরুত্ব বাড়ূক, তেমন মন্তব্য করতে চাই না।