ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রক্তপাতের শেষ কোথায়

রক্তপাতের শেষ কোথায়

দোনেৎস্ক শহরে বুধবার অভিযানের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইউক্রেনের ট্যাঙ্ক ক্রু সদস্যরা। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের জবাব দিতেও তাদের এই প্রস্তুতি এএফপি

তুহিন তৌহিদ

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০৮:০৬

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছিল তখন। বিশ্ববাসী চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছিল। তাদের সামনে আর্থিক টানাপোড়েন, অনাহার-দুর্ভিক্ষের শঙ্কা। এ অবস্থায় ১৯৩৮ সালের ৩ জুলাই যুক্তরাজ্যের কেটারিংয়ে এক সমাবেশে বক্তব্য দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আর্থার নেভিল চেম্বারলাইন। রক্ষণশীল এই নেতা যা বললেন, তা সাধারণত পদধারীদের বলতে শোনা যায় না। চেম্বারলাইন বলেন, যুদ্ধে আসলে কেউ জেতে না। যে পক্ষই নিজেকে জয়ী দাবি করুক, যুদ্ধে সবাই হারে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উক্তিটি এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। চেম্বারলাইন বলতে চেয়েছেন, মানুষের লাশের ওপর ভর করে, মানবিকতাকে হত্যা করে আসলে কেউ জয়ী হয় না।

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এরই মধ্যে এক বছর পার হয়ে গেছে। যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্বের প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে। এ অবস্থায় জয়-পরাজয়ের চেয়ে একটি প্রশ্ন সবচেয়ে আগে আসছে- যুদ্ধ কবে শেষ হবে? বিশ্ববাসী পরমাণু যুদ্ধের শঙ্কায়ও রয়েছেন। পরমাণু শক্তিধর দেশগুলো সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে এটি সর্বগ্রাসী রূপ নিতে পারে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশ। তারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। এএফপি জানায়, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সর্বব্যাপী যুদ্ধের বিষয়ে বিভিন্ন দেশকে সতর্ক করেছেন। এ জন্য উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতেও বলেছেন তিনি। গুতেরেস বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। যুদ্ধ আরও প্রকট হওয়া এবং অধিকতর রক্তপাতের আশঙ্কা বাড়ছে।

একই ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন মার্কিন দার্শনিক নোয়াম চমস্কি। গত ২৮ ডিসেম্বর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যেভাবে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছে, তাতে বিশ্বের জন্য ভয়ানক ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। এর জন্য দোষ সব পক্ষকেই দিতে চান তিনি। এর আগে গত বছরের এপ্রিলে রাশিয়ার সঙ্গে বসে কিয়েভকে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন চমস্কি।

ইউক্রেনের জরিপ সংস্থা রেটিং গ্রুপ মনে করে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের দেশই জয়ী হবে। জরিপে দেখা গেছে, ৯৭ শতাংশ ইউক্রেনীয় মনে করেন- কিয়েভ জিতবে। গত ৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার অভ্যন্তরে একটি বিমানবন্দরে ড্রোন হামলার পর ইউক্রেনের সাবেক চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল আইহর রোমানেঙ্কো আলজাজিরাকে বলেন, তাঁরা শুধু শত্রুকে প্রতিহতই করবেন না; বন্ধুদেরও শিক্ষা দেবেন।

তবে যুক্তরাজ্যের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক মাইকেল ক্লার্ক বলেন, শীত শেষে বসন্তে রাশিয়ার হামলা কেমন হবে- তার ওপর যুদ্ধের অগ্রগতি অনেকটা নির্ভর করবে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষক এন্ড্রি পয়েন্টকভস্কি মনে করেন, চলতি বছর সব ভূমি পুনরুদ্ধার করে জয়ী হবে ইউক্রেন। তবে লন্ডনের কিংস কলেজের যুদ্ধশিক্ষা বিভাগের বারবারা জেনচেত্তা বলেন, শিগগিরই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

এ বছর বেলারুশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে আরও রুশ হামলার শঙ্কা রয়েছে। যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে চলতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া রাশিয়ার প্যারামিলিটারি সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপের মালিক ইয়েভজেনি প্রিগঝিন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের শিল্প এলাকার কেন্দ্র দোনবাসের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে রাশিয়ার দেড় থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারে। আর মস্কো নাইপার নদীর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নিতে চাইলে যুদ্ধ তিন বছর পর্যন্ত চলতে পারে।

যুদ্ধের বর্ষপূর্তিতে ইউক্রেনে নতুন করে বৃহৎ পরিসরে রুশ হামলা হতে পারে বলে এরই মধ্যে ইউক্রেনীয় ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন। তবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র এন্ড্রি চেরনিয়াক কিয়েভ পোস্টকে বলেন, বৃহৎ পরিসরে আক্রমণ চালানোর সামরিক সামর্থ্য এখন রুশ বাহিনীর নেই। তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেনে কিছু কৌশলগত সফলতা পাওয়ার দিকেই এখন মূলত রুশ বাহিনীর নজর।

যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ন্যাটোয় সাবেক মার্কিন দূত কুর্ট ভলকার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সেনারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে কেবল শক্ত প্রতিরোধই গড়ে তুলবে না, তারা টিকে থাকবে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি নিউজ উইককে বলেন, ইউক্রেনীয়রা আত্মসমর্পণ করবে, বিষয়টি 'অকল্পনীয়' বলে তাঁর কাছে মনে হয়। কারণ, ইউক্রেন একটি দেশ। এর পালানোর সুযোগ নেই। এ কারণেই ইউক্রেন জিতবে। তিনি বলেন, ইউক্রেনীয়দের জন্য এটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ; কোনো সীমান্ত সংঘর্ষ নয়।

ইউক্রেনে রাশিয়া এরই মধ্যে 'হেরে গেছে' বলে মন্তব্য করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ জেনারেল মার্ক মিলে। সম্প্রতি ব্রাসেলসে ন্যাটোর প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের এক সভা শেষে তিনি বলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভদ্মাদিমির পুতিন ভেবেছিলেন, দ্রুতই ইউক্রেন দখল করে নেবেন। তিনি ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। রাশিয়া কৌশল, পরিসংখ্যান ও অভিযান- সব ক্ষেত্রেই হেরে গেছে। এখন যুদ্ধক্ষেত্রে এর মাশুল দিচ্ছে।

রুশ রাজনৈতিক বিশ্নেষক ও সিডনি ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব ম্যানেজমেন্টের ডিন ড. লিওনিড পেট্রোভ এসবিএসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, পুতিনের যুদ্ধ আরও বহুদিন চলবে বলে তিনি মনে করেন না। ওয়াগনার গ্রুপ ইউক্রেনে সফল নয়। এ গ্রুপের কারণে রাশিয়ায় গৃহযুদ্ধ দেখা দিতে পারে। ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার জন্য পশ্চিমের দেশগুলোর কঠোর সমালোচনা করেছে রাশিয়া। সেই সঙ্গে পরমাণু যুদ্ধ বাধতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। কিন্তু এতে দমে যাচ্ছে না পশ্চিমা শক্তিগুলো। তারা অব্যাহতভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা দিচ্ছে। এখন একটাই প্রত্যাশা- ইউক্রেন যেন হনুমানের লেজের আগুন না হয়; যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ যেন পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে না পড়ে।

আরও পড়ুন

×