শুল্ক ফাঁকি ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি, কার্নেট ডি প্যাসেজ এবং ডিপ্লোম্যাটিক ও প্রিভিলেজ সুবিধার অপব্যবহার করে আনা হয়েছিল বিলাসবহুল গাড়ি। এনেছিলেন প্রবাসী সিলেটিরা। অনেকেই এনেছিলেন শখের বশে, কেউবা আর্থিক ফায়দা নিতে। শখের বশে আনা এসব গাড়ি এখন অযত্নে পড়ে আছে সিলেটের বিভিন্ন থানার কম্পাউন্ডে। বিভিন্ন মামলায় আটক করা গাড়িও পড়ে আছে থানা ও বন বিভাগের কার্যালয়ের সামনে।

শুল্ক গোয়েন্দাদের আটক করা গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএমডব্লিউ, রেঞ্জ রোভার, পোরশে, পাজেরো, টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার, ল্যান্ড রোভার ও মার্সিডিজের মতো গাড়ি। তবে থানায় হস্তান্তর করার পর নির্দিষ্ট কোনো শেড বা অবকাঠামো না থাকায় এবং মামলা নিষ্পন্ন না হওয়ায় সেগুলো খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে। মালিকানা না থাকায় অনেক গাড়ি এভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সরেজমিনে বিভিন্ন থানা ও বন বিভাগের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, উন্মুক্ত স্থানে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে থাকায় অনেক গাড়িই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক গাড়ি পড়ে আছে বৃষ্টিতে জমে ওঠা পানির ভেতর। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে অনেক গাড়ির যন্ত্রাংশও চুরি হয়ে গেছে।

কোতোয়ালি থানায় দেখা গেল, থানার ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জব্দ করা অচল গাড়ি। কোনোটির সিট নেই, কোনোটির দরজা নেই, কোনোটির চাকা চুরি হয়ে গেছে, কোনোটির গ্লাস উধাও, আবার কোনোটির শুধু বডি পড়ে আছে। এগুলো এখন এমন বেহাল যে, ভাঙাড়ির দোকানে বিক্রি করার মতো। মামলা নিষ্পত্তি হলেও এগুলো আর ব্যবহার করা যাবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

কোতোয়ালি থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মামলা নিষ্পত্তি না হলে কোনো গাড়ি মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশ না পাওয়ায় কোনো গাড়ি নিলামেও তোলা যাচ্ছে না। অথচ এগুলো থানা কম্পাউন্ডের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে রেখেছে। এতে একদিকে গাড়ির মালিকদের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে থানার পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।

সিলেট কোতোয়ালি থানা কম্পাউন্ডে গিয়ে দেখা গেল, লতাপাতা ঢেকে ফেলেছে বিলাসবহুল বিভিন্ন গাড়িকে। মনে হচ্ছে, ছোটখাটো জঙ্গল গড়ে উঠেছে কিংবা স্থাপনাশিল্প প্রদর্শন করা হচ্ছে। থানার ওসির কক্ষের পাশে ও সহকারী পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের সামনে পড়ে থাকা এসব গাড়ির মধ্যে রয়েছে লেক্সাস, প্রাডো ও পাজেরো জিপ থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক অনেক গাড়ি।

গত একযুগের বিভিন্ন সময় সিলেটের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব গাড়ি আটক করেছে। থানায় নেওয়ার পর মামলাও হয়েছে। আর মামলার পর পরই এসব গাড়ির ঠিকানা হয়ে ওঠে বিভিন্ন থানার খোলা কম্পাউন্ড। ভবিষ্যতে এসব গাড়ি নিলামেও বিক্রি করা যাবে না বলে অনেকের ধারণা।

এ রকম গাড়ির মধ্যে রয়েছে ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর সিলেটের বিয়ানীবাজারের সুতারকান্দি শুল্ক স্টেশন দিয়ে অবৈধভাবে নিয়ে আসা দুই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল দুটি পাজেরো গাড়ি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিন ব্রিটিশ নাগরিক কাবুল মিয়া, আসকির আলী ও অন্তর আলী গাড়িগুলো নিয়ে ভারত হয়ে এদেশে আসেন। পুলিশি তদন্তে তাদের জড়িত থাকার বিষয়টিও প্রকাশ পায়। মামলা থাকায় এগুলোর ব্যাপারে কোনো ফয়সালা হচ্ছে না বলে জানা গেছে থানা সূত্রে।

২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে চিঠি দিয়ে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি একটি লেক্সাস গাড়ি রেখে যান। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ২০১১ সালে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধার আওতায় গাড়িটি এক বছর মেয়াদের জন্য সিলেটে নিয়ে আসেন তিনি। পরে এ সুযোগ আর বাড়াতে পারেননি। ট্যাক্স পরিশোধের সক্ষমতা না থাকায় গাড়িটিও আর ব্যবহার করতে পারেননি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তিনি গাড়িটি শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কাছে হস্তান্তর করছেন। চিঠিতে তাকে হয়রানির না করার অনুরোধ করেন তিনি। এ গাড়িটিও নষ্ট হচ্ছে কোতোয়ালি থানায়। নগরীর আম্বরখানা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা তিন কোটি টাকা মূল্যের একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িও নষ্ট হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে।

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ছয়টি থানা ছাড়াও পুলিশ লাইন মাঠে শতাধিক গাড়ি পড়ে আছে বছরের পর বছর। অধিকাংশ গাড়ি ব্যবহারের অনুপযোগী এখন। এমন গাড়িও রয়েছে যার ভেতর-বাইরে লতাপাতা বাসা বেঁধেছে। কোনো কোনো গাড়ির যন্ত্রাংশ অনেক ক্ষয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (গণমাধ্যম)  জেদান আল মুসা জানান, অনেক যানবাহন আলামত হিসেবে জব্দ আছে। কিছু গাড়ি আছে মালিক নেই। কোনো গাড়ির আবার মালিকানা নিয়ে মামলা চলছে।

বিভিন্ন সময় মামলা-হামলা, দুর্ঘটনা, মাদক পরিবহন, অবৈধ মালপত্র বহনসহ নানা অভিযোগে পুলিশ ট্রাক, প্রাইভেট কার, সিএনজি ও মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি আটক করে। মামলা শুরু থেকে নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এভাবে থানাগুলোতে পড়ে থাকে জব্দ গাড়িগুলো। একপর্যায়ে তা ব্যবহারের উপযোগিতা হারায়।

চোরাই কাঠ ও মালপত্র পরিবহনসহ নানা কারণে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বন বিভাগ গত ১০ বছরে শতাধিক যানবাহন আটক করে। বন বিভাগের সামনেও তাই পড়ে আছে বেশ কিছু গাড়ি। এসব গাড়ির বিরুদ্ধেও মামলা চলছে সিলেট মেট্রোপলিটন ও চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।