সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে বেশ পরিচিত দোকানী তরিকুল ইসলাম। তার  দৈহিক আকৃতি বেশ লম্বা। মুখে খোঁচা খোঁচা হালকা ধূসর রঙয়ের দাড়ি, শরীরে লম্বা গোলাপি রঙয়ের পাঞ্জাবি এবং মাথায় টুপি। সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়ার লেম্বু রোডে তার দোকান রয়েছে। শাক-সবজি ও অন্যান্য খাদ্য সামগ্রী বিক্রি করেন তিনি। তার গ্রাহকের অধিকাংশই বাংলাদেশি প্রবাসী। দোকানদারদের মধ্যে দৈহিক আকৃতির কারণে তিনি একটু বাড়তি নজর কাড়েন।

কিন্তু দেশটির একটি নির্মাণাধীন স্থাপনায় কয়েকজন বাংলাদেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার পর তার দোকানে গ্রাহক কমে গেছে। দু'একজন যারা আসছেন তারাও মাস্ক পরা।  অনেক গ্রাহক দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় অথবা কর্তৃপক্ষ জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেয়ায় এখন ক্রেতাশূন্য তরিকুলের দোকান। ব্যস্ত সড়ক কিছুটা জনশূন্য। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মীরা টহল দিচ্ছেন। রয়টার্সের প্রতিবেদক রোববার ছুটির দিনে সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।

সিঙ্গাপুরে ৯০ জনের দেহে করোনা ভাইরাসশনাক্ত করা হয়েছে। এদের পাঁচজন বাংলাদেশি যারা একই নির্মাণ কোম্পানিতে কাজ করতেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, ওই পাঁচজনের মধ্যে একজনের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতেও এক বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ে ফিলিপিনো ও ইন্দোনেশীয় গৃহকর্মীদের মতো সংযুক্ত আরব আমিরাতে এক বাংলাদেশি গৃহকর্মীরও এ ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

৫২ বছর বয়সী দোকানদার তরিকুল বলেন, 'অনেক লোক চলে গেছে। যখন মানুষ নিজের জীবন ও পরিবারের চিন্তা করে, তখন তারা অর্থের পরোয়া করে না।'

শুধু বাংলাদেশি শ্রমিক নয় এশিয়াজুড়ে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ভাইরাসটি নিয়ে অস্বস্তি জেঁকে বসেছে। ওদিকে হাজার হাজার মাইল দূরে পরিবারের সদস্যরা আছেন তাদের ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।

সিঙ্গাপুরে এসব শ্রমিররা রয়েছেন ভিড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরের আসা নির্মাণশ্রমিকরা সাধারণত ১২ শয্যার ডরমিটরিতে থাকেন, যেখানে তাদের সবার জন্য একটাই বাথরুম থাকে। কারাগার ও ক্রুজ শিপের মতো মানুষের ভিড়েই এই ভাইরাস ছড়ায় বেশি।

২৪ বছর বয়সী বাংলাদেশি নির্মাণ শ্রমিক কাকন মিয়া। গত কয়েক বছর ধরে সিঙ্গাপুরে আছেন তিনি। কাকন মিয়া বলেন, তারা যেখানে কাজ করেন; সেখানে অনেক বাংলাদেশি আছে। ভাইরাসের সংক্রমণ না ঘটলেও তার অনেক বন্ধু দেশে ফিরে গেছে। শহর ভাইরাস মুক্ত হলে তারা আবার ফিরে আসবে বলে জানিয়েছে।

বেশ কয়েকজন সহকর্মীর পাশে বসে মাতৃভাষায় তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত এখানে আছি। কিন্তু পরিস্থিতি খারাপ হলে আমরাও দেশে ফিরে যাবো।

সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশন বলছে, তারা সিঙ্গাপুরে বসবাসরত প্রবাসীদের সঙ্গে অনলাইনে এবং ডরমেটরিতে গিয়ে স্বাক্ষাৎ করে দেশে ফেরত না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এমনকি বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাঝে স্যানিটাইজার, মাস্ক ও বাংলা ভাষায় লেখা সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ করছেন।

হাই কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'শ্রমিকদের দেশে ফেরা ঠেকাতে আমরা বেশ সক্রিয় রয়েছি। খামোখা অযৌক্তিক ভয় যাতে তারা না পান সে বিষয়ে আশ্বস্ত করছি।'

সিঙ্গাপুরে আসা-যাওয়ায় বাংলাদেশ সরকার কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। হাই কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, এই নগররাষ্ট্রে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি কাজ করে।

রউফ নওশার্দ লেম্বু রোডে একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান, যেখানে সাধারণ বাংলাদেশি শ্রমিকরাই সেবা নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, গত ১৪ দিনে বুকিং ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে অনেকেই একদিনের নোটিসে ঢাকায় ফিরতে চাচ্ছেন। আগে কখনোই এমন হয়নি। তারা সবসময় পরিকল্পনা করে দেশি ফিরতো। এখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে সিঙ্গাপুর ছাড়তে চায়। এমনকি মাত্র একদিন আগে এসে অনেকেই সরাসরি ঢাকাগামী ফ্লাইটের অনুরোধ করছেন। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ফ্লাইটে জায়গা না থাকায় অনেককে ব্যাংকক বা কুয়ালালামপুর হয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হচ্ছে।