
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাঠে নেমেছে দক্ষিণ কোরিয়ার সেনাসদস্যরা। শনিবার দায়েগু রেলস্টেশনে তারা জীবাণুনাশক স্প্রে করেন- এএফপি
স্মরণকালের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধি করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) ধাক্কা ইতোমধ্যেই প্রবলভাবে লেগেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও অর্থনীতিতে। এবার রাজনীতিতেও লাগতে শুরু করেছে এর পরাঘাত। এর প্রভাবে ইরানের বিপদাপন্ন সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ফের তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম দেখাচ্ছে বলে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ উঠেছে।
করোনার প্রভাবে চীনের কমিউনিস্ট সরকার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। চীনের দীর্ঘ ঐতিহ্য ভেঙে নাগরিকরা সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। বিশ্নেষকরা বলছেন, করোনার ধাক্কায় চীনের মহাশক্তিধর সরকার এখন নাজুক সময় পার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকরাও করোনা নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়িতে জড়িয়ে পড়েছেন। হোয়াইট হাউস এমন অভিযোগও করছে যে, করোনা নিয়ে ট্রাম্পের পতন ঘটাতে চাচ্ছেন বিরোধীরা। জাপান, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের রাজনীতিতেও ঘটেছে করোনার সংক্রমণ।
রাজনীতিতে করোনার ঝাঁকুনি এমন সময় লাগছে যখন রোগটি দ্রুত বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্তত ৫৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৮৬ হাজার মানুষ। মারা গেছেন দুই হাজার ৯৪১ জন। আক্রান্তের মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার এবং মৃতের মধ্যে প্রায় ১০৬ জন ছাড়া বাকিরা চীনের নাগরিক। এ মুহূর্তে রোগটি বেশি ছড়াচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গতকালও সেখানে ৮১৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বশেষ গতকাল করোনার সন্ধান মিলেছে কাতারে।
ইরানের রাজনীতিতে করোনাকম্প : ভূমিকম্পের মতোই করোনা আঘাত হেনেছে ইরানের রাজনীতিতে। দেশটির ধারাবাহিক সরকারগুলো নেতিবাচক তথ্য লুকিয়ে রাখতে অভ্যস্ত বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে সেখানে করোনায় মৃতের সংখ্যা নিদারুণভাবে কমিয়ে দেখানোর অভিযোগ উঠেছে।
করোনাভাইরাসে ইরানে অন্তত ২১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে। মৃত বেশিরভাগই রাজধানী তেহরান ও দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কোমের বলে দাবি তাদের।
বিবিসি বলছে, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলোর কাছ থেকে পাওয়া মৃতের এ সংখ্যা দেশটির সরকারের জানানো সংখ্যার ছয় গুণেরও বেশি। গতকাল পর্যন্ত ইরানি কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৪৩ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এর মধ্যে গতকাল মারা গেছেন ৯ জন। তবে দেশটির
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কিয়ানুশ জাহানপুর দাবি করেন, প্রাণঘাতী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে তারা স্বচ্ছতা বজায় রাখছেন এবং কোনো ধরনের লুকোচুরি করছেন না। বিবিসির বিরুদ্ধে 'মিথ্যা প্রচারের' অভিযোগও তুলেছেন তিনি।
কোমের এক পার্লামেন্ট সদস্য এর আগে ইরানি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর তথ্য নিয়ে লুকোচুরির অভিযোগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শুধু তার আসনেই অন্তত ৫০ জন কভিড-১৯ রোগে মৃত্যুবরণ করেছে।
ইরানের সরকারি তথ্য নিয়ে জোরালো সন্দেহ জাগার সঙ্গত কারণও রয়েছে। বিশ্বে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে এক থেকে দুই শতাংশ মানুষ মারা যাচ্ছে। ইরান সরকার আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে তথ্য দিচ্ছে তা অসঙ্গতিপূর্ণ। ফলে তা কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। তেহরানের রাস্তায় ইরানের জনগণও বলাবলি করছে যে, সরকার করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আদৌ প্রস্তুত কিনা। এ ছাড়া আক্রান্ত ও মৃত্যু নিয়ে সরকারি ভাষ্যে অনেক নাগরিকই আস্থা রাখতে পারছেন না।
যুক্তরাষ্ট্রও তেহরানের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। শুক্রবার ওয়াশিংটনে কংগ্রেসনাল কমিটিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, 'আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছি। তাদের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো পরিপকস্ফ নয়; এখন পর্যন্ত দেশটির অভ্যন্তরে কী হচ্ছে, সে সংক্রান্ত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের ইচ্ছার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।' তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি যুক্তরাষ্ট্রের এ সাহায্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেন, 'ইরানে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় এমন একটি দেশ সাহায্য করতে চাইছে যারা তাদের অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে আমাদের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছে। এমনকি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ কেনার ওপরও তাদের নিষেধাজ্ঞা আছে, এটি অগ্রহণযোগ্য ও রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক খেলা।'
গতকাল ইরান প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত আরও বহু লোককে শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে। সব মিলিয়ে তাদের দেশে কভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা ৫৯৩ বলে দাবি কর্তৃপক্ষের।
তবে তেহরান শহর কর্তৃপক্ষের এক সদস্য বার্তা সংস্থা ইলনাকে বলেছেন, সামনের সপ্তাহগুলোতে ইরানে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজারে পৌঁছাতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন। ভাইরাস মোকাবিলায় সহযোগিতা করতে আজকালের মধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দলের ইরানে যাওয়ার কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে 'ধাপ্পাবাজির' রাজনীতি : করোনাভাইরাসের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভক্ত রাজনীতিতে তিক্ততা আরও বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের কিছু গণমাধ্যম এবং ডেমোক্র্যাটরা করোনার বিপদ অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করছে। ট্রাম্প বলেছেন, সিএনএন জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে সম্ভব সবকিছুই করছে। আর ডেমোক্র্যাটরা মিথ্যা বলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। তারা করোনা নিয়ে রাজনীতি করছে। এটাকে 'ধাপ্পাবাজি' বলেও মন্তব্য করেছেন ট্রাম্প।
হোয়াইট হাউসের ভারপ্রাপ্ত চিফ অব স্টাফ (প্রধান কর্মকর্তা) মিক মুলভেনি দাবি করেছেন, ট্রাম্পের পতন ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম করোনাভাইরাস নিয়ে বেশি মাতামাতি করছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়াবাজারে করোনার প্রভাবে দরপতন ঘটেছে। পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির বড় কোম্পানিগুলো। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা করোনার বিস্তার ঠেকাতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪ জন। তবে দ্রুত এ রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন করোনা নিয়ে জনগণকে নিয়ন্ত্রিত তথ্য সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য সিদ্ধান্ত হয়েছে, করোনা নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা কথা বলবেন না। জাতিকে সব তথ্য জানাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স।
চীনের কমিউনিস্ট শাসনে ঝাঁকুনি : চীনের কমিউনিস্ট সরকার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। শুরুতেই অভিযোগ ওঠে যে, প্রথমে চীন করোনার তথ্য লুকাতে চেয়েছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট জিনপিং আগেভাগেই জেনেও কার্যকর পদক্ষেপ নেননি। চীনের নাগরিকরা প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। দেশটির নাগরিকরা রাস্তাঘাটেও করোনা নিয়ে সরকারি ভাষ্যের সমালোচনা করেছে। সরকারের তথ্যকে আস্থায় নিতে পারেনি তারা। এমনকি উহানে জীবাণু গবেষণাগার থেকে করোনা ছড়িয়ে পড়েছে বলে দেশটির অনেক নাগরিকও বিশ্বাস করেছে। তবে পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা এমন সম্ভাবনার কথা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন।
চীনের প্রেসিডেন্টও স্বীকার করেছেন, এটা 'বড় সংকট এবং বড় পরীক্ষা'। নজিরবিহীনভাবে তিনি করোনা নিয়ে সরকারের 'ত্রুটিবিচ্যুতির' কথাও স্বীকার করেছেন। করোনার পর বিশ্বব্যাপী চীন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও তলানিতে ঠেকেছে। খুব কম লোকই আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে, চীন সরকার করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য দিচ্ছে। তবে চীন সরকার করোনার বিস্তার রোধে যেসব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
জাপানেও রাজনীতি : চীনের পর যে দেশটিতে দ্রুত করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছিল সেটি জাপান। জাপান সরকার নানা পদক্ষেপ নেওয়ায় রোগটি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে মনে করা হয়। জাপানে গতকাল পর্যন্ত ২০০ জন আক্রান্ত ও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জাপান সরকার করোনা ঠেকাতে এক মাস স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে সরকারের সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচকরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ খুবই কম ঘটে। ফলে সরকারের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। অন্যরা বলছে, সরকার অলিম্পিক গেমস রক্ষায় এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তীরবিদ্ধ ইতালির প্রধানমন্ত্রী : ইতালির প্রধানমন্ত্রী গিউসেপ কোঁতে দাবি করেছিলেন তার দেশ নিরাপদ। এরপরই তার সমালোচনা বাড়তে থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে করোনা ছড়াচ্ছে মূলত ইতালি থেকে। তা ছাড়া ইতালির লম্বার্ডি নিয়ে সরকার যেসব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তাও বাড়াবাড়ি ছিল বলে অনেকে সমালোচনা করছেন। ইতালিতে গতকাল পর্যন্ত ৮২১ জন আক্রান্ত এবং ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হংকংয়ে বিভাজন আরও তীব্র : ছয় মাস ধরে 'চীনের পুতুল সরকারের' বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল রয়েছে হংকং। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে করোনাভাইরাস। করোনা হংকংয়ে ছড়িয়ে পড়লে নানা ধরনের গুজব ডালপালা মেলে। এর মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, চীন থেকে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার ফলে হংকংয়ে টয়লেট পেপার সংকট দেখা দিতে পারে। এরপর সেখানে হুলস্থুল কাণ্ড ঘটে যায়। সরকার জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাইলে তাতে কান দেয়নি কেউ।
এ ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারও নজিরবিহীন চাপে পড়ে। দেশটিতে জরুরি পণ্য সরবরাহ দারুণভাবে ব্যাহত হয়। দক্ষিণ কোরিয়া করোনা নিয়ন্ত্রণে সেনা মোতায়েন করেছে। দেশটিতে গতকাল পর্যন্ত করোনায় তিন হাজার ১৫০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট সরকার কোনো সমালোচনার ধার ধারে না। দেশটির নিষ্ঠুর সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, করোনা আক্রান্তকে গুলি করে মেরেছে কর্তৃপক্ষ। তবে নির্ভরযোগ্য গণমাধ্যমগুলো এ ধরনের খবরের সত্যাসত্য যাচাই করতে পারেনি। সূত্র :বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, ডয়চে ভেলে, সিএনএন ও ফক্সনিউজ।
মন্তব্য করুন