দুনিয়ার তাবত ধনকুবের লকডাউনে যাওয়ার আগে বিলাসিতার সব উপকরণের সঙ্গে কাঁড়ি কাঁড়ি মদও নিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের সাধারণ মদাসক্তদের অত টাকা ছিল না যে, তাদের মতোই লাখ লাখ টাকার মদ কিনে মজুদ করবেন। তাই তৃষ্ণার্ত এক লকডাউন যখন সামান্য শিথিল হলো, অমনি হাজার হাজার মদ্যপিপাসু হামলে পড়ল দোকানগুলোর ওপর। সারাদেশে মদের দোকানের সামনে দেখা গেল লম্বা লম্বা সব অফুরন্ত লাইন।

করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত মুম্বাইয়ে সামাজিক দূরত্ববিধিকে কলা দেখাতে শুরু করেছিল সুরাপ্রিয় উন্মত্ত মানুষগুলো, কে কার আগে কতটা মদ সংগ্রহ করতে পারবে, এ নিয়েই হুড়োহুড়ি আর  ঠেলা-ধাক্কা। শেষে বেগতিক দেখে পুলিশকে নামতে হয়েছিল লাঠিহাতে। সরকারকে আবার মদের দোকান খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছিল। মিডিয়ায় খবর হয়েছিল ব্যাঙ্গালোরে এক সুরাপ্রেমীর ৫২ হাজার টাকায় এক বোতল মদ কেনার ব্যাপারটা। 

মদ খেয়ে মাতলামিটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু মদ কিনতে গিয়ে এমন উন্মত্ততার ব্যাপারটাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে হঠাৎ করে এমন কড়া লকডাউনে মানুষ বেদিশা হয়ে পড়েছিল। সব মানুষের কাছেই এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যা সারা জীবনেও কারো হয়নি। শুধু ভারতেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেও বেড়ে গেছে মদ বিক্রির পরিমাণ। মার্চে ব্রিটেনে গত বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫ শতাংশ বেড়েছিল ।

তবে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেন-আমেরিকার পার্থক্য হলো, ভারতে মদ কেনা বেচার ব্যাপারটা অত সহজ নয়। এই ক্ষেত্রে ই-বাণিজ্যেরও সুযোগ নেই যে, অর্ডার দিলেই হোম ডেলিভারি চলে আসবে। কোনো রাজ্যে এ নিয়ে রাজনীতিও শুরু হয়েছে। বিজেপির নেতারা তো মদ নিষিদ্ধ করার জন্য এক পায়ে খাড়া। কারণ তাতে নারী ও বুড়ো ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মদ নিষিদ্ধ হলে তাদের ভোটে ওই নেতাদের বাক্স উপচে পড়ার আশা করে তারা। ২৯টি রাজ্যের প্রতিটিরই মদ উৎপাদন, বেচাবিক্রি ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে।

এতসব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও, লন্ডনভিত্তিক আইডব্লিউএসআর ড্রিংকস মার্কেট অ্যানালাইসিসের মতে, ভারত মদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোক্তা দেশ। চীনের পেছনেই এর অবস্থান। প্রতিবছর গড়ে ৬ কোটি ৬৩ লাখ লিটার মদ খায় ভারতের লোকেরা। ২০১৭ সালের চেয়ে বর্তমানে মদ্যপায়ী বেড়েছে ১১ ভাগ।

যে অ্যালকোহলটি ভারতে সবচেয়ে বেশি চলে সেটা হলো উইস্কি। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তিন গুণ বড় ভারতের উইস্কির বাজার। সারা বিশ্বের প্রতি দুটি উইস্কির বোতলের একটি বিক্রি হয় সেখানে। ২০১৮ সালে মদের দাম কমে গেলে ভারত ৭ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে বিশ্বমার্কেটে চালকের আসনে বসে গিয়েছিল।

ভারতে সবচেয়ে বেশি মদ বেচা কেনা হয় অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলাঙ্গনা, তামিল নাড়ু, কর্নাটক ও কেরালায়। এই পাঁচটি রাজ্যে বিক্রি হয় ৪৫ শতাংশ মদ। অবাক হওয়ার কিছু নেই। রাজ্যগুলো ১০ শতাংশের বেশি রাজস্ব এসে থাকে মদবিক্রির টাকা থেকে। মদভোক্তাদের এর পরের ছয়টি রাজ্য হলো পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিম বঙ্গ। ১০ শতাংশের চেয়ে কম আর ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি রাজস্ব আসে এসব রাজ্যে।

আইডব্লিউএসআর-এর গবেষণা সংস্থাটি বলেছে, গত এপ্রিল মাসে ভারতে এক ফোঁটা মদও বিক্রি হয়নি। ফলে রাজ্যসরকারগুলোর রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটে। মদের দোকানগুলো খুলে দেয়ার পেছনে তাই সরকার ও বিক্রেতার সমান স্বার্থই কাজ করেছে।

 তবে কেবল বিক্রেতাদের দুই পয়সা লাভ ও এবং সরকারের রাজস্ব আয় অব্যাহত রাখতেই যে লকডাউন শিথিলে কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ, তা কিন্তু নয়। এটা একটা মুখোশ মাত্র। মুখোশের আড়ালে রয়েছে অন্ধকার এক সত্য…বাস্তবতাও।

 নতুন এক সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় পুরুষদের তিন ভাগের এক ভাগ মদ পান করে। ১০ থেকে ৭৫ বছর বয়সী সব ভারতীয় পুরুষের ১৪ শতাংশের চেয়েও বেশি মদ ছাড়া থাকতে পারে না। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান, যে ১১ শতাংশ ভারতীয় মদ পান করে থাকে, সারা বিশ্বের হিসেবে তাদের হার গড়ে এক শতাংশ।

 তবে উদ্বেগের জায়গাটা হলো, মদ তৈরি ও পরিবেশনের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ১৯ শতাংশ ভোক্তা নির্ভরশীল অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি দেশি মদের ওপর। ভারতের প্রায় ৩ কোটি লোক নির্ভর করে স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর এসব মদের ওপর। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা মনে করে, অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে বানানো অ্যালকোহলের পরিমাণ ভারতে তৈরি সব অ্যালেকোহলের পরিমাণের অর্ধেকের চেয়ে বেশি। ২০১৪ সালে একটি জরিপে দেখানো হয়েছে, অনেক লোকই দোকানে গিয়ে বাড়িতে তৈরি মদের খোঁজ করে।

ভারতীয়রা আগের চেয়ে বেশি মদ পান করছে এখন। ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতসহ ১৮৯টি দেশে মদ খাওয়া নিয়ে এক জরিপে দেখা গেছে অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে ভোক্তার সংখ্যা বেড়েছে ৩৮ শতাংশ।  

জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক জ্যাকব মান্দে বলেছেন, ভারতে মদ্যপায়ীর সংখ্যা বাড়ার কারণ হলো আর্থিক সচ্ছলতা। কিছু মানুষ প্রচুর টাকা কামাচ্ছে এবং তাদের সংখ্যাও বাড়ছে।

এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দেশটিতে লিভার ও হৃদরোগীর সংখ্যাও। অসংক্রামক এসব রোগকে ভারতের জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়। আর এর মূলে রয়েছে অ্যালকোহল সেবনজনিত নানা প্রতিক্রিয়া।

 এসব ছাড়াও আরেকটা ব্যাপার বড় ভয়াবহ। সেটা হলো ক্রমবর্ধমান সড়ক দুর্ঘটনা। সুলভে মদ পাওয়া এবং তার যথেচ্ছ পানে মাতাল হয়ে গাড়ি চালায় ড্রাইভাররা। ২০১২ সালে ভারতে এক তৃতীয়াংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মদ খেয়ে বেপরোয়া  ড্রাইভিংকেই দায়ী করা হয়েছিল।