- আন্তর্জাতিক
- দুই মাস্কের নগরীতে নতুন সঙ্কট
দুই মাস্কের নগরীতে নতুন সঙ্কট

ফাইল ছবি
এক বছর আগে হংকংয়ের এমন কিছু যুবক সংসদ ভবনের বাইরে জড়ো হয়েছিল, যাদের পরনে ছিল কালো পোশাক। প্রতিবাদী এসব যুবককে মোকাবিলা করতে হয় পুলিশের লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাসের। টিয়ার গ্যাসের ঝাঁজ থেকে চোখ ও নাক বাঁচাতে মাস্ক পরতে হতো তাদের। সে সঙ্কটের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে করোনা সঙ্কট। ফলে আবারও মাস্ক পরতে হচ্ছে কালো পোশাকধারী সে যুবকদের। টিয়ারগ্যাস ও ভাইরাস প্রতিরোধী মাস্কে ভারাক্রান্ত এখন তাদের মুখমণ্ডল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি টিকে থাকতে পারবে তারা? দুই মাস্ক পরেও কি অস্তিত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে?
দীর্ঘ বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও পুলিশি নির্যাতনে জেরবার হংকংয়ে চীন এতদিন সক্রিয় ভূমিকা না রাখলেও দেশটির কমিউনিস্টশাসিত সরকার এখন একটি নতুন ঘোষণা দিয়েছে। হংকংয়ে গণতন্ত্রপন্থিদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভকে ‘বিচ্ছিন্নতা ও সন্ত্রাসবাদ এবং বিদেশী হস্তক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করে এই ‘অপরাধ’ দমনে আইন প্রণয়ন করছে তারা। আইনটি সম্ভবত চলতি মাসেই অনুমোদিত হবে। তাদের ভাষায় এটি হচ্ছে ‘জাতীয় সুরক্ষা’ আইন।
আইনটি পাস হয়ে গেলে এর প্রয়োগের ফলে ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন থেকে চীনের কাছে হস্তান্তরিত হওয়ার সময় যে ‘অনন্য স্বাধীনতা’র গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছিল হংকংকে, তা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। সমালোচকরা প্রস্তাবিত আইনটিকে বাকস্বাধীনতার প্রতিবন্ধক এবং মতবিরোধ ও প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করছেন।
একজন সাবেক ছাত্রনেতা অ্যালিস চিউং বলেছেন, হংকং একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। গত বছর যা ঘটেছিল তা একরকম। কিন্তু এর পর থেকে হংকং একেবারে আলাদা হয়ে উঠতে পারে।
চিউংয়ের কাছে গত বছরটা ছিল অবিশ্বাস আর মানসিক ক্লান্তির বছর। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, তার মাতৃভূমি উদ্ভূত সে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। টিয়ার গ্যাস থেকে বাঁচার জন্য তাকে গত বছর অনেক মাস্ক পরতে হয়েছিল। সে মাস্ক এখন ডবল হয়েছে। প্রশাসনিক নির্যাতন ও তার সঙ্গে অপ্রত্যাশিত করোনা ভীতি আন্দোলনকারীদের প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে। শহরে তার সমমনা অন্যদের মতো তারও ভয়, ভবিষ্যৎ খুব কঠিন ও ভীতিকর।
হংকংয়ের গণতন্ত্রকামীরা যা-ই ভাবুক, চীন কিন্তু ব্যাপারটাকে দেখছে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা হংকংকে তাদের শাসনাধীন একটি ‘অবাধ্য ও বিশৃঙ্খল’ জনপদ হিসেবে দেখছে। হংকং অবশ্য নিজেদের জন্য জাতীয় সুরক্ষা আইন প্রবর্তনের বিষয়ে আগ্রহী ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ ধারণাটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু চীনের নতুন প্রত্যর্পণ আইন কার্যকর করার প্রয়াসের জবাবে প্রায় সবাই বেঁকে বসে এবং এর পর থেকে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে শহর জুড়ে।
নতুন প্রজন্মের কাছে এটি ভীতি ও অস্বস্তিকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তারা ‘স্বাধীনতা’ হারানোর ভয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। চিউং ও তার মত যারা, তারা পথে নেমে আসেন।
এরপরও অবশ্য আইনটির বিরোধী হয়েও স্থানীয় কিছু লোক এটিকে স্বাগত জানায়। তারা এটিকে হংকংয়ের অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বলে বিশ্বাস করলেও এর বিরুদ্ধে সরব হতে চাইছেন না।
অ্যালিস চিউং রীতিমতো মুখ খারাপ করেই তাদের এই অনুভূতিকে ‘পারস্পরিক ধ্বংস’ ক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করলেন। তার মতে, এর অর্থ হলো বেইজিং যদি হংকংয়ের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করে, তাহলে পশ্চিমা দেশগুলো হংকংয়ের জন্য বিশেষ চিকিৎসা সেবা প্রত্যাহার করে নেবে। আর এর ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চীন।
এদিকে গত মাসে হংকংয়ের জন্য বিশেষ সুবিধাগুলো সরিয়ে নেওয়া হবে বলে চোটপাট চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তাদের মতে, চীনা কর্তৃপক্ষ হংকংয়ের ন্যায্য স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্রিটেনও ঔপনিবেশিক যুগে জন্মগ্রহণকারী হংকংয়ের ৩০ হাজার অধিবাসীকে নিজেদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। জবাবে চীন কড়া হুশিয়ারি দিয়ে বলেছে, এসব করা হলে তাকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে এবং তাতে হংকং নিয়ে বড়ধরনের বৈশ্বিক বিবাদ শুরু হবে।
চিউং প্রথমে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী ছিলেন। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের ওপর বর্বর পুলিশি নির্যাতন তাকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে অসাড় হয়ে পড়েছি। কোনো সংবাদই এখন আমাকে আর স্পর্শ করে না।’
গত বছর পুলিশ প্রায় ৯ হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের প্রায় ৪০ ভাগই ছাত্র। ১১ বছরের শিশুকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে গারদে পোরা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে যে ধরনের অভিযোগ আনা হচ্ছে, তাতে অধিকাংশেরই দশ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। চীনের প্রস্তাবিত আইনটি পাস হলে এদের ভাগ্যে কী ধরনের ঘনঘটা নেমে আসবে, তা ভাবলেই অস্থির হয়ে ওঠেন তিনি। তার আশঙ্কা, একটা প্রজন্ম পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।
ঠিক এ অবস্থার মধ্যেই করোনা সঙ্কট। চিউং বলেন, এটি আমাকে ২০০৩ সালের সার্সের কথা মনে করিয়ে দেয়। আমরা তখন একদম ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিলাম।
হংকং এখন করোনার সঙ্গেও লড়ছে। হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ বাইরে যাওয়ার সময় মুখোশ ব্যবহার করেন। জানুয়ারির শেষ দিকে এটা ছিল ৬১ শতাংশ। মার্চের মাঝামঝিতে ছিল সর্বোচ্চ ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কিং-ওয়া ফু বলেন, নগর প্রশাসন প্রথমে খুব ধীরগতির প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। দেখে মনে হয়েছিল,তারা জনগণকে সহায়তা দিচ্ছে না, ঋণ দিচ্ছে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ স্বীকার করেছেন যে মহামারি মোকাবেলায় সরকার প্রযুক্তিগত দক্ষতা দেখিয়েছে। হংকংয়ে কোনো লকডাউন হয়নি এবং সংক্রমণ ও মৃতের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। হংকংয়ের চীনপন্থি প্রশাসক কেরি ল্যাম বলেছেন, প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর করতে হবে। কারণ গণতন্ত্রের নামে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে জাতীয় সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন