- আন্তর্জাতিক
- আফ্রিকার অভিবাসীদের মৃত্যুর মুখে ফেলছে সৌদি আরব
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
আফ্রিকার অভিবাসীদের মৃত্যুর মুখে ফেলছে সৌদি আরব

পৃথিবীর অন্যতম সম্পদশালী দেশ সৌদি আরবে করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে অনেক ধরনের অভিযান চালানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে লিবিয়ার দাস-শিবিরগুলোতে আফ্রিকার শত শত অভিবাসীকে বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আটকে রেখেছে। যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম 'দ্য সানডে টেলিগ্রাফে'র অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
'দ্য সানডে টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় বন্দিশিবিরগুলোর ভেতরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বদ্ধকামরায় শ্রমিকরা কীভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তার বেশ কয়েকটি স্থিরচিত্র দেখা গেছে।
অনেক অভিবাসীই তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়ে নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন। এক ইথিওপিয়ান অভিবাসী মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ফোনে যোগাযোগ করে জানান, চারমাস ধরে তিনি একটা ডিটেনশন কেন্দ্রে আটকা রয়েছেন। জায়গাটি তার কাছে নরকের মতো। তাদের সঙ্গে জন্তু জানোয়ারের মতো আচরণ করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিদিন তাদের পেটানো হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, পালানোর কোনো উপায় না পেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে অনেক অভিবাসীই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন।
ইথিওপিয়ান ওই অভিবাসী বলেন, 'আমার একমাত্র অপরাধ জীবনকে আরও উন্নত করতে এখানে এসেছিলাম। তারা আমাদের প্রতিদিন চাবুক এবং বৈদ্যুতিক তার দিয়ে এমনভাবে মারধর করে যেন আমরা কোনো খুনের আসামি।'
বন্দিশিবিরগুলোর ভেতরের দৃশ্য এবং সাক্ষীদের বক্তব্য মানবাধিকারকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের অনেক স্থানে প্রতিবাদ চলছে।
মিডলারের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর উপ-পরিচালক অ্যাডাম কুগল বলেন, দক্ষিণ সৌদি আরবের বন্দিশিবিরের ছবিগুলো থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেখানকার কর্তৃপক্ষ হর্ন অফ আফ্রিকার অভিবাসীদের নিরাপত্তা বা মর্যাদার কথা চিন্তা করেননি। তাদেরকে বিক্ষিপ্ত, জনাকীর্ণ ও অমানবিক পরিবেশে রেখেছেন।
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ সৌদি আরবের বন্দিশিবিরগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের কোনো বালাই নেই। সৌদি আরবের মতো দেশে অভিবাসীদের এইরকম অমানবিক পরিস্থিতিতে আটকে রাখার ক্ষেত্রে কোনো অজুহাতই যথেষ্ট নয়।
তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকা ও এশিয়া থেকে নেওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ করছে। ২০১৯ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী সৌদিতে প্রায় ৬৬ লাখ অভিবাসী শ্রমিক কাজ করছেন। এদের বেশিরভাগই স্বল্প বেতনে কঠোর পরিশ্রমের কাজ করেন। অভিবাসীরা মূলত নির্মাণ এবং গৃহস্থালীর কাজই বেশি করেন।
'দ্য সানডে টেলিগ্রাফ' অনুসন্ধানে যে বন্দিশিবিরগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেখানে বেশিরভাগ ইথিওপীয় পুরুষ রয়েছেন। অন্যান্য স্থানে নারীরাও একই অবস্থায় আছেন বলে জানা গেছে।
বন্দিশিবিরে থাকা একজন জানান, পাঁচ মাস ধরে অমানবিক জীবনযাপনের ফলে প্রচুর কয়েদী আত্মঘাতী হয়েছেন। অনেকে মানসিক অসুস্থতায় ভূগছেন। আরেকজন জানান, প্রহরীরা আটকদের নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। সেই সঙ্গে প্রহরীরা এটাও বলেন, তোমাদের সরকারের যেখানে চিন্তা নেই, আমরা কী করবো?
বন্দিশিবিরে থাকা একজন জানান, গত মাসে ১৬ বছর বয়সী একটি ছেলে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। রক্ষীরা মৃতদেহগুলো এমনভাবে ফেলে দেয় যেন তারা আবর্জনা পরিষ্কার করছে।
মার্চে যখন করোনাভাইরাস সৌদি আরবে আঘাত হানে তখন সরকার আশঙ্কা করেছিল অভিবাসী শ্রমিকরাই ভাইরাস ছড়াবে। কারণ তারা জনাকীর্ণ পরিবেশে বাস করে।
প্রায় ৩ হাজার ইথিওপীয় নাগরিককে এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরবর্তীতে আরও ২ লাখ অভিবাসীকে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু রিয়াদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ থাকায় তা স্থগিত করা হয়।
সানডে টেলিগ্রাফের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পাঁচ মাস আগে থেকে থেকে যারা ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকা রয়েছেন তাদের অনেকেই নানা রোগে ভূগে মারা যাচ্ছেন। ডিটেনশনের ক্যাম্পের একজন জানান, ক্লাসরুমের মতো একটি ঘরে মার্চ মাস থেকে তারা আটকা রয়েছেন। তার ভাষায়, এখানেই তাদেরকে পচে মরতে হবে। তিনি আরও জানান, ডিটেনশন ক্যাম্পে অনেকেই নানা রোগে ভূগছেন। কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবাও তারা পাননি।
ইথিওপীযোন এক যুবক জানান, তারা দিনে ছোট এক টুকরো রুটি এবং সন্ধ্যায় ভাত খান। প্রায়ই দিনই পানি পান না। টয়লেটগুলি উপচে পড়েছে। শতাধিক লোক গরমের মধ্যে এক ঘরে গাদাগাদি করে থাকছে। প্রচণ্ডের দুর্গন্ধের মধ্যে তাদের ঘুমাতে হচ্ছে।
সৌদি আরবে আফ্রিকান অভিবাসীদের কয়েকটি আইনি অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। এর আগেও অনেক অভিবাসী নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে শোষণ, যৌন নিপীড়ন ও জাতিগত নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোন ফল পাননি।
অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমাবদ্ধ করে ২০১৩ সালে সৌদি আরবে নতুন আইন প্রবর্তন করা হয়। ২০১৭ সালে প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের পর এই আইন আরও কঠোর করা হয়।
সানডে টেলিগ্রাফের পক্ষ থেকে লন্ডনে সৌদি আরব দূতাবাসের কাছে অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো মন্তব্য জানতে পারেনি।
মন্তব্য করুন