পণ্ডিত, কলাম লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা চার বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিবাদী তৎপরতা নিয়ে লিখে চলেছেন। অনেকের লেখায় মনে হয়েছে, ট্রাম্প জমানার আগে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এর বিপদের দিকটি বুঝে সে দেশের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও ইতিহাসের অধ্যাপক স্যামুয়েল মোয়ন বলেছেন, 'হত্যা, পরাধীনতা এবং সন্ত্রাসের সঙ্গে আমাদের গণতন্ত্রের সহাবস্থানের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।'
অধ্যাপক স্যামুয়েল বোঝাতে চাইছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময় যে বর্ণবাদ ও ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা ব্যতিক্রম কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের ইতিহাস দীর্ঘ এবং এখনও তা চলমান। বহু আগেই দেশটিতে কালো মানুষের বিরুদ্ধে পুলিশি এবং উগ্র-শ্বেতাঙ্গ নির্যাতন কাঠামোগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার বিপরীত চিত্রও রয়েছে। কারণ, অনেক শ্বেতাঙ্গ আবার কালোদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভও করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বড় শহরে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (কালোদের জীবনও মূল্যবান) আন্দোলন চলছে। ৩ নভেম্বর দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কাজেই এ আন্দোলন প্রধান দুই রাজনৈতিক শিবিরে কাজ বাড়িয়েছে। কালোদের ভোট টানতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা নানা হিসাব কষছেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ভোটারের সংখ্যা সাড়ে ১৫ কোটি। তাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার তিন কোটি। শতাংশের হিসাবে যা দেশটির মোট ভোটারের ১২ দশমিক ৫ শতাংশ। হিস্পানিক ভোটারের সংখ্যা তিন কোটি ২০ লাখ, যা মোট ভোটারের ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। তাই জো বাইডেন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-পরাজয়ে তারাই সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা পালন করবেন।
বিভিন্ন সময় রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বর্ণবাদী এবং অভিবাসীবিরোধী মন্তব্যের কারণে অনেকে মনে করতে পারেন, কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের ভোট তাহলে ডেমোক্র্যাটরাই পাবেন। কিন্তু হিসাব অতটা সহজ নয়। ইউগভ-সিবিএস নিউজের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, ২০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন, ট্রাম্প তাদের পক্ষে কাজ করছেন। ৫০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন, ট্রাম্প তাদের বিরুদ্ধে রয়েছেন। বাকি ৩০ শতাংশ কোনো মন্তব্য করেননি। ৪৯ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন, ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তাদের পক্ষে কাজ করবেন। ২২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ মনে করেন, বাইডেন তাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। বাকিরা মন্তব্য করেননি। শুধু কৃষ্ণাঙ্গ ভোটেই তো আর বাইডেন জিততে পারবেন না।
তাই শ্বেতাঙ্গ (এমনকি উগ্র-শ্বেতাঙ্গদের) মনোভাবের বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন একচেটিয়াভাবে ট্রাম্পের পক্ষে রয়েছে। জিততে হলে তাদের মনও তো জয় করতে হবে বাইডেনকে। ইউগভ-সিবিএসের জরিপে আরও দেখা গেছে, ৬৬ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ মনে করেন, ট্রাম্প তাদের পক্ষে কাজ করছেন। মাত্র ৪ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ এর বিরোধিতা করেছেন। ৩০ শতাংশ কোনো মন্তব্য করেননি। অন্যদিকে ৩৪ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ মনে করেন, বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তাদের পক্ষে কাজ করবেন। ৩২ শতাংশ এর বিরোধিতা করেছেন এবং ৩৪ শতাংশ মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির ন্যাশনাল কমিটির প্ল্যাটফর্মের ওয়েবসাইটে বলা রয়েছে, সমাজে ও অর্থনীতিতে যে কাঠামোগত বর্ণবাদ রয়েছে, ডেমোক্র্যাটরা তা নির্মূল করবেন। ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থাকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত সংস্কার করা হবে। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, কালোদের জীবনও মূল্যবান। দলটি থেকে বাইডেনের ডেপুটি হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিনেটর কমলা হ্যারিস। তাই সন্দেহ নেই, কালোদের ভোট কাটতেই কমলাকে মনোনয়ন দিয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টি।
একটু পেছনে ফিরে ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের দিকে নজর দেওয়া যাক। কমলাও ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জন্য লড়েছিলেন। ২৭ জুনের বিতর্কে বাইডেনকে বর্ণবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলেন কমলা। গত শতকের সত্তর দশকে সিনেটর হওয়ার পর অন্য সিনেটরদের সঙ্গে মিলে স্কুলসহ বিভিন্ন স্থানে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের পৃথক্‌করণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বাইডেন। কমলা সে বিতর্কে বলেছিলেন, বাইডেনদের কারণে তখন কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলশিক্ষার্থী হিসেবে তিনি বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। এ ছাড়া বাইডেনের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের বহু অভিযোগ আছে।
রিপাবলিকানরাও কৃষ্ণাঙ্গ, হিস্পানিকদের উন্নতির জন্য নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে করোনাভাইরাস মহামারি চোখে আঙুল দিয়ে ফের কৃষ্ণাঙ্গদের দুরবস্থা দেখিয়ে দিয়েছে। ১৩ আগস্ট প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে নাগরিক সংগঠন ন্যাশনাল আরবান লিগ জানিয়েছে, প্রতি এক হাজার ৪৫০ জন কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে একজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। অন্যদিকে, শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে এ হার প্রতি তিন হাজার ৩৫০ জনে একজন। শ্বেতাঙ্গরা করোনায় আগ্রাসী চিকিৎসাসেবা পেয়েছে, কৃষ্ণাঙ্গরা তা পায়নি। ট্রাম্প যে 'মহান আমেরিকা' গড়তে চেয়েছেন, সে দেশটিতে বৈষম্যের চিত্র এখানেই শেষ নয়। গত চার বছরেও ১৯ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও ১১ দশমিক ৫ শতাংশ হিস্পানিককে স্বাস্থ্যবীমার আওতায় আনা হয়নি।
দশকের পর দশক কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর যে পুলিশি নিপীড়ন চলছে, তাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন তারা। ট্রাম্পকে বেশিরভাগ কৃষ্ণাঙ্গ সমর্থন করেন না ঠিক, কিন্তু বাইডেনকে কি তারা আসন্ন নির্বাচনে সমর্থন দেবেন? ডেমোক্র্যাটরা হয়তো ইতিবাচক কিছু ভাবতে পারতেন, যদি তাদের অতীত রেকর্ড ভালো থাকত। ১৯৯৪ সালে বাইডেন যে 'অপরাধ আইন' প্রণয়ন করেছিলেন, তা নিয়ে সম্প্রতি চুলচেরা বিশ্নেষণ হচ্ছে। কারণ, ওই আইন পুলিশকে অধিক ক্ষমতা দিয়েছে এবং গণগ্রেপ্তারে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে এখনও। যার প্রধান শিকার হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের 'গণতান্ত্রিক চাকচিক্য' দেখে ভাবার কোনো কারণ নেই, দেশটিতে সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি হয় না। হয়তো বটেই। তাতে কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী সংখ্যালঘুরা বরাবরই ঠকে এসেছে। এবারের নির্বাচনেও কৃষ্ণাঙ্গ ভোট বাইডেন ও ট্রাম্পের জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দেবে। যেই জিতুন না কেন, তাতে কৃষ্ণাঙ্গদের জয় হবে না। তবে বর্ণবাদ ও পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে যে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার মধ্যেই কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসীদের 'জয়ের আলো' মিটমিট করে জ্বলতে শুরু করেছে।

বিষয় : ট্রাম্প-বাইডেন

মন্তব্য করুন