- আন্তর্জাতিক
- 'আমার মেয়েরাও কি শান্তির খোঁজ পাবে না' প্রশ্ন আফগান নারীর
'আমার মেয়েরাও কি শান্তির খোঁজ পাবে না' প্রশ্ন আফগান নারীর

১৩ জুলাই, ২০২১। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল সেই দিন। আফগানিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গজনির মালিস্তান জেলার বাসিন্দারা বুঝতে পারলেন তালেবান যোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এবার পৌঁছে গেছে তাদের ছোট শহরে। অবশ্য এর কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে এই শহরের চারদিকে তালেবান যোদ্ধাদের উপস্থিতির খবর তারা পাচ্ছিলেন।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তালেবান যোদ্ধারা ওইদিন মালিস্তান জেলার বিভিন্ন স্থানে গুলি চালিয়ে তাণ্ডব চালাতে শুরু করে। আফগানিস্তান সরকার আর তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে এদিন ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেদিন দুপুর নাগাদ ওই জেলার কোল-এ-আদম গ্রামের সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২২ বছর বয়সী ফাতেমা নিজেকে আর পেটের সন্তানকে বাঁচাতে পাগলের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করেন। ফাতেমার নিরাপত্তা নিয়ে পরিবারের সদস্যরাও বিচলিত ছিলেন। কারণ তাদের ভয় ছিল, যদি তালেবান যোদ্ধারা গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নেয় তাহলে তারা অন্য তরুণীদের মতো ফাতেমাকেও ধরে নিয়ে যাবে।
গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাতেমা বলেন, আমরা শুনেছি তালেবান যোদ্ধারা গ্রাম দখল করে যুবকদের হত্যা করছে, আর মেয়ে ও তরুণীদের ওপর যৌন নির্যাতন করছে।
ফাতেমা এবং তার পরিবারের আশঙ্কার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। কারণ এমন ঘটনা তার গ্রামেও ঘটেছে। ফাতেমা জানান, তালেবান যোদ্ধারা গ্রামে ঢোকার পর একটি অল্প বয়সী মেয়েকে তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। পরে মেয়েটি নিজেদের বাড়ি ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
ফাতেমা আরও জানান, তালেবান যোদ্ধারা বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে নারীদের খাবার তৈরি করে দিতে এবং তাদের কাপড় পরিষ্কার করে দেওয়ারও আদেশ দিচ্ছিল।
তালেবান যোদ্ধারা মালিস্তান দখল করার তিনদিন পর ফাতেমা সেখান থেকে পালিয়ে যান। ফাতেমা বলেন, 'আমি গজনী শহরে পৌঁছানোর জন্য পরিবারের সাথে গোটা দিন ও সারারাত পাহাড়ি পথ ধরে হেঁটেছি। পরে কাবুলে পৌঁছানোর জন্য তিন গুণ বেশি অর্থ দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে এসেছি।
ফাতেমা জানান, তার গ্রামের ৫০ থেকে ৬০টি পরিবারের সব সদস্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শুধুমাত্র বয়স্করাই গ্রামে রয়ে গেছেন সম্পত্তি রক্ষার আশায়।
আফগানিস্তানের গ্রাম ও শহরে তালেবান যোদ্ধাদের তাণ্ডবের খবর দেশজুড়ে নারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘরহারা বেশিরভাগ পরিবার এখন রাজধানী কাবুল এবং হেরাতের মতো বড় শহরে আশ্রয় খুঁজছেন।
অনেকের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ফাতেমা এবং তার পরিবারের মতো হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত পরিবার কাবুলের পার্ক এবং অন্যান্য খোলা জায়গায় থাকছে। প্রতিদিনই এমন বাস্তুহারা লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে।
আফগানিস্তান স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের (এআইএইচআরসি) তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে প্রায় ১০ লাখ আফগান বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আফগান শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাস্তুচ্যুতদের প্রায় ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু।

ফাতেমার মতো কান্দাহার থেকে পালিয়ে হেরাতে এসেছেন শুকরিয়া নামের এক নারী। তার স্বামী অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিনিই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য।
শুকরিয়া বলেন, আমাদের অনেক কিছু ছিল না। কিন্তু অন্তত মাথার ওপর ছাদ ছিল। কিন্তু এখন আমার পুরো জীবন কাপড়ের এই কয়েকটি ব্যাগে আটকে গেছে।
শুকরিয়ার মতো গফুরীও তার অসুস্থ স্বামী আর দুই মেয়েকে নিয়ে নিরাপত্তার জন্য হেরাত শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। তার শঙ্কা, এখন তালেবান বাহিনী যদি আবার এই শহর দখলে নেয় তাহলে আবারও তিনি আশ্রয় হারাবেন।
গফুরী বলেন, গত তিন সপ্তাহ ধরে আমরা হেরাতের এক বাসিন্দার বাড়িতে থাকছি। কিন্তু এখনই হোক কিংবা পরেই হোক তারা আমাদের বের করে দেবে কারণ এখানকার পরিস্থিতিও সঙ্কটজনক। তারপর আমাদের মসজিদে থাকতে হবে।
মে মাসের শুরুর দিকে, আফগানিস্তান থেকে যখন বিদেশি সেনা প্রত্যাহার শুরু হয় তখন থেকে তালেবান দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখল নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে তারা আফগানিস্তানের দু্ইশ'র বেশি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
দেশটির শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে, তালেবান যোদ্ধারা বেসামরিক পুরুষদের হত্যা এবং নারী ও মেয়েদের বিয়েতে বাধ্য করছে। তবে মন্ত্রণালয় বা এআইএইচআরসি- কেউই এইসব তথ্য যাচাই বা তদন্ত করতে সক্ষম হয়নি।
অনেকেই বলছেন, তালেবানরা নব্বইয়ের দশকের চেয়ে বেশি হিংস্র এবং নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে। আফগান সমাজবিজ্ঞানী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলী আমিরি বলেন, তালেবান যোদ্ধারা বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সাথে কীভাবে আচরণ করবে তা নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, তালেবান যোদ্ধারা ভূমি দখলের পর মেয়ে এবং নারীদের সঙ্গে কী অবস্থা হবে তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে হাজার হাজার পরিবার এলাকা ছাড়ছে। তার ভাষায়, নব্বইয়ের দশকের চেয়ে এখনকার তালেবান যোদ্ধারা অনেক বেশি হিংস্র। নারীরা এখন শিক্ষা, কর্মক্ষেত্রে, মানবাধিকারের ব্যাপারে অনেক সোচ্চার। তালেবান এই বিষয়গুলো কীভাবে দেখছে সেটাই ভয় জাগাচ্ছে।
বাস্তুচ্যুতদের অনেকেই কাবুল শহরের ক্যাম্পে বা মসজিদে থাকছেন। কিছু অল্পবয়সী মেয়ে শহরের অপরিচিতদের বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছে। সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর আশ্রয়দাতার মধ্যে ৬০ বছর বয়সী রহিমাও আছেন। তিনি পশ্চিম কাবুলে তার বাড়িতে অনেক তরুণী ও নারীকে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, দুই সপ্তাহ ধরে আমার বাড়ি অতিথিতে ভরপুর। ব্যক্তিগতভাবে আমার ঘর হারানোর অভিজ্ঞতা আছে। আমি জানি নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা কতটা কষ্টকর।
আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাত মেয়ের মা রহিমা। তিনি বলেন, আমি নিজের মেয়েদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত। আমার জীবদ্দশায় শান্তির অভিজ্ঞতা পাইনি এবং এখন আমি চিন্তিত যে আমার মেয়েরাও কখনই শান্তি পাবে না।
ঘর ছেড়ে পরিবার নিয়ে পালিয়ে বেড়ানো ফাতেমা, গফুরীদের মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
গফুরী বলেন, এই যুদ্ধে পালিয়ে থাকতে থাকতে আর ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। তারপরও নিরাপদ বোধ করছি না। এভাবে আর কতক্ষণ আমরা দৌড়াতে পারবো?
মন্তব্য করুন