আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন সরকার বলেছিল, বিশ্ববাজারে কমলে দেশেও কমবে। কয়েক দিন থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী। কিন্তু দেশে তেলের দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের এখনও কোনো উদ্যোগ নেই। আদৌ কমবে কিনা- এ বিষয়ে কিছুই বলছে না সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা সংস্থা।

গত ৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। বিশ্নেষকরা বলছেন, কয়েক মাস ধরে বাড়তে থাকা জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে চলতি মাসের মাঝামাঝি থেকে কমতে থাকে। ব্যারেলপ্রতি প্রায় ৯০ ডলার স্পর্শ করা ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ১৯ নভেম্বর ৮০ ডলারের নিচে নেমে যায়। বাড়া-কমার মধ্য দিয়ে গত শুক্রবার প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ৭২.৭২ ডলারে নেমে আসে, যা গত ২০ আগস্টের পর সর্বনিম্ন। গত ২০ আগস্ট আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট অয়েলের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৬৫.১৮ ডলার। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও তার প্রভাব এখনও পড়েনি
বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের মার্কেটে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রভাব যাচাই না করে হুট করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। এখন সরকার তেলের দাম কমালেও বাস ভাড়া, পণ্য পরিবহনসহ নিত্যপণ্যের বর্ধিত দাম কি আদৌ কমবে?

করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি চাঙ্গা হতে থাকলে চলতি বছর অপরিশোধিত তেলের দাম প্রায় ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। চাপে পড়ে বিশ্ব অর্থনীতি। বাজার নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ কয়েকটি দেশ মজুদ থাকা তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দেয়। এরপর তেলের বাজারে একটু লাগাম পড়ে। এর মধ্যে করোনার নতুন ধরন ছড়িয়ে পড়ায় ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশ আবার চলাচল সীমিত করছে। ফলে স্বাভাবিক হতে থাকা বিশ্ব অর্থনীতি আবার একটা ধাক্কার মুখে পড়তে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে জ্বালানি তেলের বাজারে।

বাজার বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, করোনা মহামারির কারণে হ্রাস পাওয়া জ্বালানি তেলের দাম চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে ব্রেন্ট অয়েল প্রতি ব্যারেলের দাম ৬০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। ৫ জুলাই দাম ওঠে ৭৭.৩১ ডলার। ২৭ সেপ্টেম্বর হয় ৭৮.৭২ ডলার। ২০ অক্টোবর দাম বেড়ে হয় ৮৫.৮২ ডলার।

বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় লোকসান হচ্ছে- এমন যুক্তিতে হুট করে গত ৩ নভেম্বর বাংলাদেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে।

এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে ডিজেলের দাম প্রতিবেশী দেশের তুলনায় কম। পাচারের শঙ্কা থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে। আর বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছরের জুন মাসে লিটারপ্রতি ২.৯৭ টাকা, জুলাইয়ে ৩.৭০, আগস্টে ১.৫৮, সেপ্টেম্বরে ৫.৬২ টাকা এবং অক্টোবরে ১৩.০১ টাকা ভর্তুকি দিয়ে গত সাড়ে পাঁচ মাসে ডিজেলের জন্য বিপিসির লোকসান হয়েছে প্রায় ১১৪৭.৬০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে এক ডলারের মূল্য ২০১৬ সালে ৭৯ টাকা থেকে চলতি মাসে ৮৫.৭৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে ডলারে মূল্য পরিশোধে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে। তাই দাম না বাড়িয়ে সরকারের উপায় ছিল না।

পক্ষান্তরে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের সরকার গত ৪ নভেম্বর পেট্রোল ও ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে যথাক্রমে ৫ ও ১০ রুপি কমিয়েছিল।

এদিকে, আমাদের দেশে ডিজেলের দাম বাড়ায় ৭ নভেম্বর গণপরিবহনের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়নো হয়। বেড়ে যায় পণ্য পরিবহন ব্যয়। যার প্রভাবে বাজারে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে চলে যায়।

গত ৬ নভেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে তার প্রতিফলন ঘটবে। গতকাল এ বিষয়ে জানতে চাইলে নসরুল হামিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার প্রভাব সম্পর্কে এখনও বিপিসি কিছু জানায়নি। তাদের লাভ হচ্ছে কিনা- এ বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দেয়নি। বিপিসির লাভ-ক্ষতির হিসাব দেওয়ার পর বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

এ বিষয়ে কথা বলতে বিপিসির চেয়ারম্যান, পরিচালকসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৭৪ ডলারের ওপরে গেলে তাদের লোকসান গুনতে হয়। এখন বিশ্ববাজারে দাম ৭৩ ডলারের কম। এ বিষয়ে বিপিসির সাবেক একজন পরিচালক জানান, বর্তমানে যে দাম রয়েছে, তার প্রভাব ২০ থেকে ৩০ দিন পর পাওয়া যাবে। কারণ, তেল কেনার পর তা দেশে আনতে এই সময় লাগে।

জানা গেছে, যেদিন জাহাজে তেল ভরা হয়, ওই দিন ও আগের-পরের দু'দিন করে পাঁচ দিনের দামের গড়ই তেলের ক্রয়মূল্য হিসেবে পরিশোধ করে বিপিসি।

গত ১১ নভেম্বর জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান এক ওয়েবিনারে বলেছিলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। যখন পরিস্থিতি আওতার বাইরে গেছে, তখন দাম বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া উপায় ছিল না।

বিশ্ববাজারে দাম কমার পর এখন সরকারের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে জ্বালানি সচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার মন্তব্য মেলেনি।

বুয়েটের শিক্ষক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম সমকালকে বলেন, হুট করে তেলের দাম বাড়ানো ঠিক হয়নি। আরও একটু পর্যবেক্ষণ করা দরকার ছিল। কারণ, ২০ দিনের মধ্যে দাম পড়তে শুরু করেছে। তিনি বলেন, চার মাসে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকির কারণে বিপিসি তেলের দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু এর প্রভাবে জনজীবনে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যয় বেড়ে গেছে। ২৩ শতাংশ তেলের দাম বাড়িয়ে পরিবহন ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে। দেশে দাম সরকার কমাবে কিনা, তা দেখার বিষয়। সরকার না হয় দাম কমিয়ে দিল; কিন্তু পরিবহনসহ যেসব খাতে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তা কি কমবে? বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, কমবে না। ফলে জ্বালানি তেলের দাম কমালে দেখা যাবে, পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীদের পকেট ভারী হচ্ছে।