চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর প্রথমদিকে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার ওপরেই মাও সে তুংয়ের উত্তরসূরি আশির দশকের চীনা নেতাদের বাস্তবভিত্তিক কিছু উপলব্ধির ওপর গড়ে উঠেছিল চীনের এক নয়া অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থা, যাকে চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন অভিহিত করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি হিসেবে।
এই অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থার ভিত্তি হলো বাজার অর্থনীতির মধ্যে সম্পৃক্ত থেকে সম্পত্তিতে ও ব্যবসায় রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন। চীনা নেতাদের মতে, এই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি সমাজতন্ত্রের বিকাশের প্রাক-পর্যায়। এ সূত্র ধরেই চীনা অর্থনীতিতে আসে আগের নিরেট সমাজতান্ত্রিক ধারায় সংস্কার, যা চীনা অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে একীভূতকরণে সাহায্য করেছিল। এর সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দেং জিয়াওপিংয়ের উপলব্ধি থেকে। এ ধারণা অবশ্য সমাজতান্ত্রিক প্ল্যান্ড ইকোনমির অনেকটাই বিপরীত। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির দিকে সংস্কার কার্ল মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই নিহিত। আশির দশকের শেষে চীনা নেতারা তাদের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুংয়ের এই ধারণা বর্জন করেন যে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এজেন্সিগুলোই অর্থনৈতিক প্রগতির একমাত্র নিয়ামক। বরং তারা এই ধারণা পোষণ করতে থাকেন- বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তিগুলোর অগ্রগতিই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় ভিত্তি। তাই তারা বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির অগ্রগতির জন্যই বাজার ব্যবস্থার সংস্কারকে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
চীনের সরকার ব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কম, তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হয়। এ ছাড়াও চীনের কেন্দ্রীয় যে কোনো সিদ্ধান্ত খুব কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। কৃষি বাজার উন্মুক্তকরণ, কুটির শিল্পের উন্নতি, ব্যক্তি বিনিয়োগের স্বাধীনতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ, আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, অর্থনৈতিক জোন তৈরি, দক্ষ জনশক্তি, জাতীয় সঞ্চয়ের উচ্চমান- এসব কারণেই চীন গত ৪০ বছরে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভে সক্ষম হয়েছে। চীন পৃথিবীর এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ; আমদানিতে দ্বিতীয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিল বিশ্ববাণিজ্যের ১ শতাংশেরও কম। আর ১৯৮৫ সালের মধ্যে দেশটির রপ্তানির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যায় এবং এর দুই দশকেরও কম সময় পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ডলারে। পণ্য রপ্তানির বিচারে চীন পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হিসেবে। চীন গত ৩০ বছর ধরে গড়ে ১০ শতাংশ জিডিপি অর্জন করেছে, যা আর কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
চীন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ফাইভজি প্রযুক্তির বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ ছাড়া তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব প্রস্তুতিই শেষ করেছে। বর্তমানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ১৭৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় অন্তত তিন গুণ। এই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০০ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতির আকার ২০৩১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপ-আমেরিকা প্রভাবিত বর্তমান বিশ্বকাঠামোর প্রতি চীন ইতোমধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীন অবশ্য এর জন্য আমেরিকাকেই দোষারোপ করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যিক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, তা বাইডেন প্রশাসনও বহাল রেখেছে। এর লক্ষ্য যে চীনের উত্থান ঠেকানো, তা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু চীনের উত্থান যে পশ্চিমা ও সেই সঙ্গে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভীতির সঞ্চার করেছে, তার যৌক্তিক কারণও আছে। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি চীনের অশ্রদ্ধা, নিজ দেশে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ, উইঘুরে গণতন্ত্রকামী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন, তাইওয়ানসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ এই ভীতিকে উস্কে দিচ্ছে। তবে চীন বলছে, আশির দশকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের নীতির সঙ্গে আমেরিকার বর্তমান পদক্ষেপ চীনের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা, সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার শামিল।
গৌরাঙ্গ চন্দ্র সরকার :ব্যাংকার
এই অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন ব্যবস্থার ভিত্তি হলো বাজার অর্থনীতির মধ্যে সম্পৃক্ত থেকে সম্পত্তিতে ও ব্যবসায় রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন। চীনা নেতাদের মতে, এই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি সমাজতন্ত্রের বিকাশের প্রাক-পর্যায়। এ সূত্র ধরেই চীনা অর্থনীতিতে আসে আগের নিরেট সমাজতান্ত্রিক ধারায় সংস্কার, যা চীনা অর্থনীতিকে বৈশ্বিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে একীভূতকরণে সাহায্য করেছিল। এর সূচনা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দেং জিয়াওপিংয়ের উপলব্ধি থেকে। এ ধারণা অবশ্য সমাজতান্ত্রিক প্ল্যান্ড ইকোনমির অনেকটাই বিপরীত। কিন্তু চীনের সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির দিকে সংস্কার কার্ল মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যেই নিহিত। আশির দশকের শেষে চীনা নেতারা তাদের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুংয়ের এই ধারণা বর্জন করেন যে, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এজেন্সিগুলোই অর্থনৈতিক প্রগতির একমাত্র নিয়ামক। বরং তারা এই ধারণা পোষণ করতে থাকেন- বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তিগুলোর অগ্রগতিই সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় ভিত্তি। তাই তারা বস্তুগত উৎপাদিকা শক্তির অগ্রগতির জন্যই বাজার ব্যবস্থার সংস্কারকে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
চীনের সরকার ব্যবস্থায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কম, তাই যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব হয়। এ ছাড়াও চীনের কেন্দ্রীয় যে কোনো সিদ্ধান্ত খুব কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়। কৃষি বাজার উন্মুক্তকরণ, কুটির শিল্পের উন্নতি, ব্যক্তি বিনিয়োগের স্বাধীনতা, বৈদেশিক বিনিয়োগ, আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা, দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণ, অর্থনৈতিক জোন তৈরি, দক্ষ জনশক্তি, জাতীয় সঞ্চয়ের উচ্চমান- এসব কারণেই চীন গত ৪০ বছরে অর্থনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য লাভে সক্ষম হয়েছে। চীন পৃথিবীর এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ; আমদানিতে দ্বিতীয়। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৮ সালে চীনের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার, যা ছিল বিশ্ববাণিজ্যের ১ শতাংশেরও কম। আর ১৯৮৫ সালের মধ্যে দেশটির রপ্তানির পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি ডলারে পৌঁছে যায় এবং এর দুই দশকেরও কম সময় পর এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার ট্রিলিয়ন ডলারে। পণ্য রপ্তানির বিচারে চীন পরিণত হয় বিশ্বের বৃহত্তম দেশ হিসেবে। চীন গত ৩০ বছর ধরে গড়ে ১০ শতাংশ জিডিপি অর্জন করেছে, যা আর কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব হয়নি।
চীন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও ফাইভজি প্রযুক্তির বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ ছাড়া তারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সব প্রস্তুতিই শেষ করেছে। বর্তমানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ১৭৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার, যা প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেটের তুলনায় অন্তত তিন গুণ। এই হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ২০০ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের অর্থনীতির আকার ২০৩১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করবে। এর মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার ক্ষমতা কাঠামোতেও পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। ইউরোপ-আমেরিকা প্রভাবিত বর্তমান বিশ্বকাঠামোর প্রতি চীন ইতোমধ্যে অনেক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীন অবশ্য এর জন্য আমেরিকাকেই দোষারোপ করছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্যিক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, তা বাইডেন প্রশাসনও বহাল রেখেছে। এর লক্ষ্য যে চীনের উত্থান ঠেকানো, তা সহজেই বোধগম্য। কিন্তু চীনের উত্থান যে পশ্চিমা ও সেই সঙ্গে চীনের প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভীতির সঞ্চার করেছে, তার যৌক্তিক কারণও আছে। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি চীনের অশ্রদ্ধা, নিজ দেশে হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ, উইঘুরে গণতন্ত্রকামী ও সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন, তাইওয়ানসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ এই ভীতিকে উস্কে দিচ্ছে। তবে চীন বলছে, আশির দশকে আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের নীতির সঙ্গে আমেরিকার বর্তমান পদক্ষেপ চীনের প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা, সেই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার শামিল।
গৌরাঙ্গ চন্দ্র সরকার :ব্যাংকার
মন্তব্য করুন