ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে অগ্নিপরীক্ষায় চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার বোঝা মাথায় নিয়ে এই যুদ্ধ জয়ে বেইজিংয়ের সহযোগিতা লাগবেই মস্কোর। তবে 'বেস্ট ফ্রেন্ড' আখ্যা দেওয়া ভদ্মাদিমির পুতিনের পাশে শেষপর্যন্ত কতটা কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে, তা নিয়ে ঐতিহাসিক কারণেই সরল ব্যাখ্যার সুযোগ নেই।

সম্পর্কের নানা জটিল সমীকরণের পথচলায় সাম্প্রতিক কয়েক বছর চীন-রাশিয়ার বন্ধুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঈর্ষার কারণ। বিশেষ করে ইউক্রেনে হামলার আগে শীতকালীন অলিম্পিক ঘিরে বিষয়টি আরও প্রকাশ্যে আসে। নিজ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ তাদের একঝাঁক মিত্র চীনের অলিম্পিক আসর কূটনৈতিকভাবে বয়কট করে। এত বড় আয়োজনে বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যোগ দেননি বা আমন্ত্রিত হননি। একমাত্র পরাশক্তির রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বেইজিংয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। জিনপিংয়ের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। শীর্ষ দুই নেতার বৈঠককে বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন মোড় হিসেবে দেখা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ার কোনো রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে দীর্ঘদিন পর কমিউনিস্ট চীনের কোনো নেতার গভীর আস্থার প্রতিফলন তাতে পাওয়া যায়। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পুতিনকে সবচেয়ে ভালো বন্ধু (ব্রেস্ট ফ্রেন্ড) আখ্যা দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চীনের সম্পর্ককে 'লৌহকঠিন' অভিহিত করেন জিনপিং।

তখন ইউক্রেন সীমান্তে রণহুংকার তুলছিলেন রাশিয়ার লক্ষাধিক সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সেই সময় পুতিনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন। ইউক্রেনে 'আগ্রাসন' চালালে পুতিনকে চরম মূল্য দিতে হবে বলেও শাসাচ্ছিলেন তিনি। তবে চীনের পক্ষ থেকে তখনও বলা হয়, রাশিয়ার নিরাপত্তার 'বৈধ' দাবিকে সমর্থন করে বেইজিং। মস্কোর এসব দাবি সম্পর্কে এরই মধ্যে পরিস্কারভাবে জেনে গেছে বিশ্ব। রুশ সীমান্তে ন্যাটো সম্প্রসারণ এবং ইউক্রেনকে কোনোভাবেই তার সদস্য করা যাবে না। এসব নিয়ে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে হামলার আগে পুতিন যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাকেও বেইজিং মস্কোর নিরাপত্তার স্বার্থ হিসেবেই বর্ণনা করে।

ইউক্রেন যুদ্ধের ২২ দিন পার হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। কথিত মহাশক্তির রাশিয়া এত দিনেও ইউক্রেনে তার লক্ষ্য পূরণ করতে পারল না- যেভাবেই এর ব্যাখ্যা ভাবা হোক মোটেও তা প্রশ্নাতীত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা ইউক্রেনকে প্রতিরোধযুদ্ধের শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। শুধু নিজ দেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পত্তন করা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানও টাকার বস্তা পাঠাচ্ছে দেশটিতে।

শেষ পেরেক হিসেবে রাশিয়ার সঙ্গে সব ধরনের স্বাভাবিক বাণিজ্য শুক্রবার থেকে বন্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি-৭। রাশিয়ার বৈশ্বিক ব্যাংকিং লেনদেনও প্রায় বন্ধ। পশ্চিমা ব্যাংকে জব্দ হয়েছে রাশিয়ার প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। যুদ্ধের জন্য প্রতিদিন পুতিনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। এত ব্যয়বহুল যুদ্ধ কতদিন চালিয়ে যেতে পারবেন তিনি, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্যের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, রসদ ও অর্থের টান পড়েছে রাশিয়ার। তাই চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা চাইছে। তাতে সাড়া না দিতে বেইজিংকে এক অর্থে হুমকিই দিচ্ছে ওয়াশিংটন। এখন কী করবেন জিনপিং?

চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক মোটেও সরল নয়। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আবর্তিত এই দুই দেশ এখন কৌশলগত বন্ধু হলেও গত শতকের সত্তরের দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বিশ্ব ব্যবস্থায় তাদের বিপরীতমুখী অবস্থান ছিল। তারও আগে কমিউনিস্ট চীনের গোড়াপত্তনের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর কমরেড মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনের মূলভূখণ্ডে গঠিত হয় কমিউনিস্ট রাষ্ট্র- পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। তাইওয়ানে গড়ে ওঠে রিপাবলিক অব চায়না। সমাজতন্ত্রের বিরোধী হিসেবে পশ্চিমারা তাইওয়ানকে স্বীকৃতি দেয় এবং জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে টিকে থাকে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মাও সে তুং তখনকার অপ্রতিরোধ্য সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্টালিনের দরবারে হাজির হন। আলোচনা এগোয়, চুক্তি হয়, বিপুল পরিমাণ সহযোগিতাও পায় চীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিসহ ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো গুছিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যেভাবে 'মার্শাল প্ল্যান' বাস্তবায়ন হয়েছিল, ঠিক একইভাবে চীনের পাশে দাঁড়িয়েছিল রাশিয়া। বিষয়টির বিস্তারিত আমরা দেখতে পাই ওড আর্নে ওয়েস্ট্যাডের বিখ্যাত বই 'দ্য কোল্ড ওয়ার :আ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি'তে।

একটি সংশয় রাশিয়ার ছিল। সমাজতান্ত্রিক মাতবর হিসেবে চীন আবার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে কিনা। এ নিয়ে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ রাশিয়া ও চীনের মধ্যে ছিল। ওড আর্নে ওয়েস্ট্যাডের ভাষায়, ষাটের দশকে সোভিয়েত শাসক নিকিতা ক্রুশ্চেভ মনে করেছিলেন- পশ্চিমা বিশ্বেও মাওয়ের বিপ্লব ছড়িয়ে পড়বে। তবে দুই সমাজতান্ত্রিক শক্তির এই যূথবদ্ধ পথচলা হোঁচট খায়। সীমান্ত বিরোধ চরম রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রায় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়। পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেরও হুমকি দেয় রাশিয়া। তখন চীন ঘুরে যায় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে।

১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকে বসেন মাও সে তুং। কমিউনিস্ট চীন জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য পদ নেয় আর তাইওয়ান সদস্য পদ হারায়। দেশটির স্বাধীনতার প্রশ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে মাও শাসিত চীনকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বরণ করে নেন নিক্সন। শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বন্ধুত্বের পথচলা। তখন তাদের যৌথ প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়ন।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত পতনের পর ঐতিহাসিক পথচলা একটু একটু করে ঘুরতে থাকে। রাশিয়ার বৈশ্বিক প্রভাব কমে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চীন বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে বিস্তার করে ব্যবসা-বাণিজ্য। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, জার্মানির উন্নত প্রযুক্তিকে টক্কর দিয়ে আফ্রিকা ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সস্তা প্রযুক্তি নিয়ে হাজির হয় চীন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারও চীনা প্রযুক্তিপণ্যের ছড়াছড়ি হয়। সামরিক দিক থেকেও এগিয়ে যায় দেশটি। নৌপথের নিয়ন্ত্রণেও সুর চড়া করে বেইজিং। ২০১০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে চীন। বিশেষ করে অর্থনৈতিক দিক থেকে। শুরু হয় তাদের বাণিজ্য যুদ্ধ। তখন দীর্ঘসময় দূরে ঠেলে রাখা রাশিয়ার কাছে ফিরে যায় চীন। রাশিয়াও তার বাজারের দুয়ার খুলে দেয়। শি জিনপিং চীনের ক্ষমতায় বসার পর থেকে পুতিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে।

জিনপিং বলেছেন, চীন-রাশিয়ার সম্পর্কের সীমা অসীম। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১ সালে তাদের বাণিজ্যের দিকে তাকালে। গত বছর তাদের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ৩৬ শতাংশ। ওই বছর তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৪৭ বিলিয়ন ডলার। পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য চীনের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন পথে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া। চীনের উচ্চাভিলাষী 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডে'ও যুক্ত হয়েছে মস্কো। আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সুযোগ বাড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং, এয়ারবাস, মার্টিন হকহিডের মতো বড় বড় অস্ত্র কোম্পানির বিপরীতে দুই দেশ সামরিক ক্ষেত্রেও অগ্রগতির পথে হাঁটছে।

চীনের লক্ষ্য- যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লমুক্ত বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা। একাধিকবার জিনপিং বলেছেন, বিশ্বটা আর যুক্তরাষ্ট্রের একার কথায় চলবে না, সেই দিন শেষ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, মোট সম্পদের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে এখন বিশ্বের শীর্ষ দেশ চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যবস্থায় ছড়ি ঘোরানোর মতো হয়ে উঠতে পারেনি চীন। ইউক্রেন যুদ্ধ সেই সুযোগ করে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে চলায় গুরুত্ব দিচ্ছে বেইজিং। রাশিয়ার বাজার না হারিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে সখ্য যতটা ধরে রাখা যায় তারা সেই চেষ্টাই করছে।

একটি কথা বলতেই হবে। পুতিন যেভাবে হারানো সোভিয়েত অঞ্চল নিয়ে কষ্ট প্রকাশ করেন এবং তা পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত দেন, তাতে চীনের সায় থাকার কথা নয়। কারণ, বৈশ্বিক আধিপত্যের লড়াইয়ের পথে চীন নতুন করে বড় প্রতিপক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করতে চাইবে না। আবার রাশিয়ার বাজারও হারাতে চাইবে না। অনুমান করা যায়, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া জিতে আসুক, যুক্তরাষ্ট্র ভাবমূর্তি সংকটে পড়ূক- এমন চিন্তা থেকে বুঝেশুনে যতটা সম্ভব রাশিয়ার পাশে থাকবে চীন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর কথায়ও তার কিছুটা আভাস মেলে। গত সোমবার তিনি বলেন, রাশিয়ার ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে চায় না চীন। এখন দেখার বিষয়- কোথার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়।