- আন্তর্জাতিক
- মারিউপোল নগর যেন পৃথিবীর বুকে 'নরক'
মারিউপোল নগর যেন পৃথিবীর বুকে 'নরক'
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা

ইউক্রেনের মারিউপোল শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ইউক্রেনীয় সেনাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। তা প্রত্যাখ্যান করে কিয়েভ বলেছে, শেষ সৈন্য বেঁচে থাকা পর্যন্ত লড়াই চলবে। শহরটিতে তাদের পরাজয় হলে সেটি হবে রাশিয়ার জন্য কৌশলগত বিজয়। সেখান থেকে ক্রিমিয়ায় সরাসরি যোগাযোগ করতে পারবে রুশ সেনারা। মারিউপোলে আটকে পড়া বাসিন্দারা বলছেন, তাদের শহরটি এখন কার্যত পৃথিবীর বুকে এক নরক।
মারিউপোল আজভ সাগরের তীরে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রথমত, সেখানে পরাজয় হলে আজভ সাগরের সঙ্গে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে ইউক্রেন। দ্বিতীয়ত, এটি যুদ্ধে রাশিয়াকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহের যে খালের মুখে ইউক্রেন বাঁধ দিয়েছে, সেটি খুলে দিতে পারবে রাশিয়া। যে কারণে এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে থাকা দেশগুলোর নজর এখন মারিউপোলের দিকে।
দুই সপ্তাহের বেশি সময় শহরটি অবরোধ করে রেখেছে রুশ বাহিনী। সেখানে গোলাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় লড়াইরত ইউক্রেনীয় সৈন্য ও মারিউপোল নগর কর্তৃপক্ষকে সোমবার মস্কো সময় ভোর ৫টার মধ্যে আত্মসমর্পণ করার সময় বেঁধে দেয়। আত্মসমর্পণ করলে শহরের বাসিন্দা ও ইউক্রেনীয় সৈন্যদের দুটি নিরাপদ করিডোর দিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তবে ইউক্রেন সরকার এবং মারিউপোলের স্থানীয় প্রশাসন প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রীকে উদ্ৃব্দত করে দেশটির সংবাদমাধ্যম ইউক্রোনিস্কা প্রাভদা বলেছে, আত্মসমর্পণ বা অস্ত্র সমর্পণের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
মারিউপোল শহরের মেয়রের এক উপদেষ্টা বিবিসিকে বলেছেন, নিরাপদে চলে যাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মস্কো দিয়েছে, তাতে বিশ্বাস করা যায় না। শেষ সৈন্য বেঁচে থাকা পর্যন্ত প্রতিরোধ চলবে।
আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর রাশিয়া হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি। এখন মারিউপোল শহর ও সেখানে আটকে পড়া বাসিন্দাদের কপালে কী ঘটবে, তা নিয়ে গভীর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, শহরটিতে এখনও তিন লাখের মতো মানুষ রয়েছে।
মারিউপোলের মানবিক পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে সেখানকার এমপি ইয়ারোস্লাভ জেলেজনিয়াক বলেছেন, শহরটি এখন কার্যত পৃথিবীর বুকে এক টুকরো নরকের মতো। তিনি বলেছেন, পুরো শহরটি ঘিরে রয়েছে রুশ সেনারা। বিদ্যুৎ নেই, পানি সরবরাহ নেই। খাবার ও ওষুধের মজুত খুবই কম। মানুষ খাবার কষ্টে ভুগছে এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ছে।
স্থলপথ ছাড়াও আকাশ ও সাগর থেকে পরপর রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা এসে পড়ছে। বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রতি ১০ মিনিটে একটি গোলা আঘাত করছে। প্রাণ বাঁচাতে অধিকাংশ মানুষ এখন ঠান্ডা আর অন্ধকার বম্ব-শেল্টার, বেজমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে। শহরের কেন্দ্রে ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও রুশ বাহিনীর সঙ্গে পেরে উঠছে না। শহর থেকে তাদের পালানোর সুযোগও নেই।
মারিউপোল শহরের মেয়র ভাদিম বোভচেঙ্কো বিবিসিকে বলেন, শহরের ৮০ শতাংশ আবাসিক ভবন হয় বিধ্বস্ত হয়েছে, না হয় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় মরদেহ পড়ে আছে। বোমা ও গুলির ভয়ে লাশ সৎকারও করা যাচ্ছে না।
রাশিয়ার অভিযোগ, মারিউপোলের পরিস্থিতির দায় ইউক্রেনীয়দের ও দেশটির উগ্র জাতীয়তাবাদীদের। তারাই বেসামরিক মানুষকে নিরাপদে চলে যেতে দিচ্ছে না, জিম্মি করে রেখেছে।
কিয়েভে শপিংমলে হামলা, নিহত ৮ :কিয়েভের উত্তর-পূর্বের ছোট শহরে একটি ১০ তলা শপিংমল রুশ হামলায় তছনছ হয়ে গেছে। রাশিয়ার দাবি, মলটি রকেট সিস্টেম সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল।
মানবিক সংকট তীব্র হচ্ছে :ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ লাখের বেশি মানুষ দেশ ছেড়েছে, যার মধ্যে শুধু পোল্যান্ডে গেছে ২১ লাখের বেশি মানুষ। এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে। স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও রাশিয়ায়ও লাখ লাখ মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তবে পোল্যান্ডে মাত্রাতিরিক্ত শরণার্থী যাওয়ায় সেখানে আবাসন ও খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে।
সীমান্তবর্তী পোল্যান্ডের ক্রাকাউ শহর থেকে দারিয়া নামে এক স্বেচ্ছাসেবী বিবিসিকে বলেন, সর্বত্র এখন একটি সংকট, যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। তাই সেখান থেকে দেশটির বিভিন্ন ছোট শহরে শরণার্থীদের পাঠানো হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের স্থানান্তরও কঠিন হচ্ছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের আইনশৃঙ্খলা কমিশনার ইলভা জহানসন জানিয়েছেন, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের মধ্যে ১৫ লাখের বেশি শিশু। তারা পাচার ও অপহরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ ছাড়া এতিম ও সারোগেট শিশুদেরও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
শান্তি আলোচনা চলছে :ইউক্রেনের অন্যান্য শহরেও লড়াই চলছে। তবে দু'পক্ষের মধ্যে অনলাইনে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রোববার রাতে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, সমঝোতার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।
ইউরোপের নেতাদের সঙ্গে বাইডেনের ফোনালাপ :ইউক্রেন যুদ্ধে আরও মনোযোগী হওয়ার অংশ হিসেবে গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউরোপের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাগির সঙ্গে রাশিয়াবিরোধী পদক্ষেপ জোরদারে কথা বলেছেন তিনি। সূত্র :বিবিসি, এএফপি ও স্পুটনিক নিউজ।
মন্তব্য করুন