- আন্তর্জাতিক
- পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এত প্রভাব কেন
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর এত প্রভাব কেন

ছবি: সংগৃহীত
বিভিন্ন নাটকীয়তার মাধ্যমেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হলো তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানকে। এরপর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তবে এতসব ঘটনার মধ্যেও সামনে এসেছে দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাবের বিষয়টি।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচলিত আছে- পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা। আর দেশটির সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর নেতা হচ্ছে আসলে সেনাপ্রধান।
এটাও বলা হয়, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি আর প্রতিরক্ষানীতি ঠিক হয় সেনা সদর দপ্তরে, সেখানে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর কোন এখতিয়ারই নেই। যখনই পাকিস্তানে কোনো বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, সেটা যে রাজনৈতিক দলেরই হোক, তাদেরকে একটা আপোস বা সমঝোতা করতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব এত বেশি কেন। জানা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু দেশটির রাজনীতিতে এর প্রভাব কতটা-
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর দেশটিতে এ পর্যন্ত তিনটি সফল সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটি হয় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের নেতৃত্বে এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এরপর ব্যাবপ গণবিক্ষোভের মুখে আইয়ুব খানের পতন হলে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহইয়া খান। কিন্তু দু’বছর পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের পর তাকেও ক্ষমতা ছাড়তে হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে দ্বিতীয় সফল সেনা অভ্যুত্থান হয় জিয়াউল হকের নেতৃত্বে। ১৯৭৭ সালে তিনি সামরিক আইন জারি করেন এবং এর পরের বছর ১৯৭৮ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানের তৃতীয় সেনা অভ্যুত্থান হয় ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বে। পরে অবশ্য ২০০১ সালে তিনি বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২৪৩ অধ্যায়ের ১নং ধারা অনুযায়ী- ফেডারেল সরকারের ওপর সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশটির ইতিহাসের ৭৫ বছরের মধ্যে সামরিক বাহিনী পাকিস্তান শাসন করেছে ৩৩ বছর। এমনকি বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্র নীতিতে সামরিক বাহিনীর বিস্তর প্রভাব থাকে।
পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবেই দেশটির সামরিক বাহিনী বেশ শক্তিশালী হিসেবেই আবির্ভূত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরপরই ভারতের সঙ্গে সীমানা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। এক বছরের মধ্যে কাশ্মীর নিয়ে প্রথম দফার যুদ্ধও হয়ে যায়। যার কারণে পাকিস্তান সব কিছুর আগে প্রতিরক্ষা তথা সামরিক বাহিনীকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘নিরাপত্তার বিষয়ে তারা সবসময় সেনাবাহিনীকে প্রাধান্য দেয়। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে তাদের যে বৈরী সম্পর্ক আছে, এছাড়া তারা তিনটা বড় যুদ্ধ করেছে এবং বিভিন্ন সময়ে ছোট ছোট বেশ কিছু সংঘাত রয়েছে। সবকিছু মিলে তাদের রাষ্ট্রের ক্ষমতার কেন্দ্রে সেনাবাহিনীই থেকেছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় সম্পদে যে পরিমাণ ভাগ পায় তা দিয়ে তারা তাদের কাঠামোগত শক্তিও বৃদ্ধি করেছে বছরের পর বছর ধরে। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের সিনেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ সালে সেনাবাহিনী প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের একটি বাজেট নেয় নিজেদের জন্য। যা সেবছর দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরকারি ব্যায় ছিল। কমপক্ষে ৫০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাবসায়িক অংশীদারিত্ব রয়েছে সেনাবাহিনীর। এসব প্রতিষ্টানের মধ্যে বেকারি এবং চিনির কারখানা থেকে শুরু করে ব্যাংক-এয়ারলাইন্সও রয়েছে। ২০০৮ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর বিনিয়োগ ছিল আনুমানিক প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নিজেদের অভ্যন্তরে অটোনমি রক্ষা করে চলে, সেখানে তারা কাওকে হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। পাকিস্তানের সামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব সামরিক বাহিনীকে যে কোনো স্বাধীনতা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে কোনো হস্তক্ষেপ করতে যায়নি। দেশটির সামরিক বাহিনীও বেসামরিক সরকারকে বলেছে যে, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দরকার। আর এই স্বাধীনতার ব্যবহার করে সামরিক বাহিনী শুধু তাদের সক্ষমতাই বাড়ায়নি, বরং কর্পোরেট এবং প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ও গড়ে তুলেছে।
২০১৭ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম হাবপোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯৫১ সালে সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন জেনারেল আইয়ুব খান। ১৯৫৪ সালে তার মেয়াদ আরও ১ বছর বাড়ানো হয়। কিন্তু এই সময়ে দেশটিতে সাত জন প্রধানমন্ত্রী রদবদল হয়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলো কখনই শক্তিশালীভাবে গড়ে ওঠেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- বিভিন্ন সময়ে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে বারবার শক্তির বিচারে রাজনীতির তুলনায় সামরিক বাহিনী এগিয়ে থেকেছে। এছাড়া পাকিস্তানে যেসব রাজনৈতিক দল রয়েছে তারা বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ক্ষমতায় আসা, ক্ষমতা ধরে রাখা বা কাউকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ- সেটাও করেছে। আর এসব কারণেই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকায় রয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ ছাড়া দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোও পারষ্পারিক কোন্দলে যুক্ত থাকার কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক একক কোনো দলও যেমন গড়ে ওঠেনি তেমনি এসব রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমতে শুরু করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর বিকল্প হিসেবেও অনেক ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চায় সাধারণ মানুষ।
মন্তব্য করুন