- আন্তর্জাতিক
- সিঙ্গাপুরে সিঙ্গেল নারীরা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পারবেন, তবে...
সিঙ্গাপুরে সিঙ্গেল নারীরা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পারবেন, তবে...

সিঙ্গাপুরে এখন ডিম্বাণু সংরক্ষণ বৈধ। ছবি: বিবিসি অনলাইন
ইচ্ছাকৃতভাবে কয়েক বছর গড়িমসি করে শেষে গতমাসে সিঙ্গাপুর ঘোষণা দেয়, চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই এখন থেকে চাইলে ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে পারবেন দেশটির সিঙ্গেল নারীরা। অনেকে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আবার অনেকে বলছেন, এই প্রক্রিয়া শুরুর জন্য এখনো কিছু সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে এবং সিঙ্গাপুরকে এই নীতি সত্যিকার অর্থে গ্রহণের আগে এখনো কিছু পথ যেতে হবে।
গোয়েনডোলিন ট্যান সিঙ্গাপুরের একজন নারী। তিনি যখন নিজের ডিম্বাণু সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেন তখন তার বয়স ৩১ বছর। তিনি কর্মজীবী সিঙ্গেল নারী। তিনি সব সময় তার নিজের বায়োলজিক্যাল সন্তান থাকুক এটা চেয়েছেন। কিন্তু এখনো তার সঙ্গী হয়নি। তাই তার সন্তান নেওয়ার চাওয়া পূরণে সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো তার ডিম্বাণু সংরক্ষণ করে এটা নিশ্চিত করা যে, সন্তান ধারণের জন্য তিনি কারও কাছে যাননি। এই আশা থেকেই তিনি বিমানে চড়েন এবং হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক যান। যেখানে ডিম্বাণু সংরক্ষণের প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করেন তিনি।
গোয়েনডোলিন বলেন, এটা করা খুব ব্যয়বহুল। ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে তাকে ১০,৯৩২ মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি এবং সিঙ্গাপুরের আরও অনেক নারী যারা ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে চান-তাদের একমাত্র উপায় বিদেশ গিয়ে তা সংরক্ষণ করা। কারণ সিঙ্গাপুরে ডিম্বাণু সংরক্ষণ নিষিদ্ধ।
২০২০ সালে দেশটির সামাজিক এবং পারিবারিক উন্নয়ন (মিনিস্ট্রি অব সোসাল অ্যান্ড ফ্যামিলি ডেভেলপমেন্ট, এমএসএফ) মন্ত্রণালয় ডিম্বাণু সংরক্ষণকে বৈধতা না দেওয়ার ব্যাপারে বলে, ডিম্বাণু সংরক্ষণকে বৈধতা দেওয়ার ব্যাপারে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নৈতিক এবং সামাজিক উদ্বিগ্নতাকেও তাদের বিবেচনায় নিতে হয়েছে।
যদিও গত মাসে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি এবং ঘোষণা করে, ২০২৩ সাল থেকে ২১-৩৫ বছর বয়সী সিঙ্গেল নারীকে তাদের ডিম্বাণু সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হবে। তবে এর সঙ্গে কিছু শর্তাবলীও জুড়ে দিয়েছে দেশটি। এর মধ্যে রয়েছে- সিঙ্গেল নারী তাদের সংরক্ষিত ডিম্বাণুগুলো কেবল তখনই ব্যবহার করতে পারবেন যখন তারা বৈধভাবে বিবাহিত হবেন।

আর এই শর্তাবলী তাৎক্ষণিকভাবে সেইসব সিঙ্গেল নারীদের ডিম্বাণু সংরক্ষণের সুযোগের বাইরে ঠেলে দিয়েছে, যারা বিয়ের বাইরে গিয়ে সন্তান জন্ম দিতে চান। সিঙ্গেল নারীদের পাশাপাশি এটি সমকামী যুগলদের জন্যও বাধা তৈরি করেছে, কারণ সিঙ্গাপুরের আইনে সমকামীরা বিয়ে করতে পারেন না।
প্রজননের উর্বরতা সংরক্ষণ
বিশ্বব্যাপী ডিম্বাণু সংরক্ষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ‘এগ ফ্রিজিং’ নামে পরিচিত এই ডিম্বাণু সংরক্ষণ প্রক্রিয়াটি সিঙ্গেল নারীরা এই জন্য গ্রহণ করেন যেন ইচ্ছামতো সন্তান ধারণের জন্য তা কাজে লাগানো যায়। বৈজ্ঞানিকভাবে এই পদ্ধতিকে ওসাইটে ক্রিয়োপ্রিজারভেশন ( Oocyte Cryopreservation) বলা হয়। সাধারণভাবে আগে ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যাত্ব হিসেবে পরিচিত শারীরিক সমস্যার চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছিল। এ ছাড়া ক্যানসার আক্রান্ত বা অন্যান্য শারীরিক জটিলতার ক্ষেত্রেও নারীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় দেরিতে সন্তান নিতে চান এমন নারীদের মধ্যেও এই পদ্ধতি দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
এই পদ্ধতিতে কম বয়সে নারীর প্রজনন সক্ষমতা ভালো থাকা অবস্থাতেই ডিম্বাণু নিয়ে তা মাইনাস ১৯৬ ডিগ্রির মতো তাপমাত্রায় বিশেষভাবে সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় এবং সুবিধাজনক সময় শুক্রাণুর সঙ্গে নিষিক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়।
সোসাইটি ফর অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলোজির হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ৪৭৫ জন নারী তাদের ডিম্বাণু সংরক্ষণ করেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩,২৭৫ জনে, বাড়ার হারে যা ২৫০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি।
সিঙ্গাপুরে একই অবস্থা। মালয়েশিয়ার একটি ক্লিনিক ২০২১ সালে বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, তারা সিঙ্গাপুরের ব্যাপক সংখ্যক নারীকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে আসতে দেখেছেন। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরের নারীরা যতবেশি এই পদ্ধতি গ্রহণের দিকে ঝুঁকছেন এটির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আওয়াজ তত বেশি বেড়েছে।
এমা সিঙ্গাপুরের নারী। যিনি ২০২১ সালে ‘মাই এগ, মাই টাইম’ শীর্ষক একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেন এবং সিঙ্গাপুরে ডিম্বাণু সংরক্ষণের বৈধতার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। এমা বলেন, প্রচারণার রেসপন্স ছিল খুবই ইতিবাচক। আমি অসংখ্য নারীর কাছ থেকে বার্তা পেয়েছি যেখানে তারা কেন ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে চান সেটি শেয়ার করেছেন।
এ ছাড়া বিষয়টি দেশটির সংসদ সদস্য চেং লি হুই বার বার পার্লামেন্টে উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে যখন প্রথমবার এটি আমি উত্থাপন করি তখন মানুষজনের মনোভাব ছিল, এটা আবার কি? আপনি আমাদের জন্য খুব বেশি আধুনিক। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। গত বছর (বিষয়টি আমি উত্থাপনের পর) এটির প্রতিক্রিয়ায় সত্যিই আমি বড় ধরনের তফাৎ দেখতে পাই। আমাকে ধন্যবাদ দেওয়া প্রচুর ইমেইল আমি পেয়েছি।
অনেকে আবার এটিকে স্বাগত জানিয়েছেন এই কারণে যে, এটি সিঙ্গাপুরের জন্মহার বাড়াতে পারে। কারণ নারী প্রতি সন্তান জন্মদানের দিক থেকে বিশ্বের তলানির দেশগুলোর একটি সিঙ্গাপুর। ২০২০ সালে যা নেমেছিল নারীপ্রতি ১.১-এ। বিশ্বব্যাপী গড়ে যা ২.৪।
দেশটিতে লিঙ্গ সমতা নিয়ে কাজ করা ‘অ্যাওয়ার’-এর রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসির প্রধান শৈলী হিঙ্গরানী বলেন, এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে কিছু শর্তাবলী থাকায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
সিঙ্গাপুরের পরিবার ভাবনার ঐতিহ্য
বিশ্বের আধুনিক শহরগুলোর একটি হলো সিঙ্গাপুর। যদিও দেশটি আবার খুব রক্ষণশীলও। বিশেষ করে ‘পরিবার’ ধারণার ক্ষেত্রে এবং পরিবারকে ‘সমাজের প্রধান ভিত্তি’ ধরা হয় দেশটিতে।
হিঙ্গরানী বলেন, পরিবারের একটি সীমাবদ্ধ সংজ্ঞাকে দেশটি বড় আকারে সামনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে। যে পরিবার বলতে ঐতিহ্যগতভাবে বুঝায় বাবা, মা আর সন্তান।
রাষ্ট্রীয় নীতিতে এই ধরনের পরিবারকেই উৎসাহিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অবিবাহিত ও সিঙ্গেল বাবা-মার ক্ষেত্রে আবাসন সুবিধার দেওয়ায়ও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
হিঙ্গরানী আরও বলেন, সিঙ্গাপুরের আবাসন নীতিতে সিঙ্গেল অবিবাহিত মা এবং তার সন্তানকে ‘পরিবার’ বিবেচনা করে না। যা তাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে।
অবিবাহিতদের (এলজিবিটি যুগলসহ, যারা আইনত বিয়ে করতে পারে না) পাবলিক হাউজিং ফ্ল্যাট ক্রয়ের জন্য বয়স ৩৫ বছর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া ফ্ল্যাট বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়।

ডিম্বাণু সংরক্ষণের শর্তাবলীতে পরিবর্তন আনার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা এমন প্রশ্নে দেশটির সামাজিক ও পারিবারিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, দেশটির সরকারি নীতি হলো বিয়ের মাধ্যমে অভিভাবকত্বকে উৎসাহিত করা।
এই ব্যাপারে হিঙ্গরানী বলেন, এটা হতাশাজনক তবে বিস্ময়কর নয়। তিনি বৈবাহিক অবস্থা, আর্থিক সক্ষমতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে সবার জন্য ডিম্বাণু সংরক্ষণ সুবিধা ঐচ্ছিক করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
সিঙ্গাপুরে ডিম্বাণু সংরক্ষণের নতুন নীতির আরেকটি বড় ইস্যু হলো, দেশটি কেবল ৩৫ বছরের কম বয়সী নারীদের ডিম্বাণু সংরক্ষণের অনুমতি দেবে। এটি যুক্তরাজ্যের ফার্টিলাইজেশন রেগুলেটর হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথোরিটির (এইএফইএ) দেওয়া গাইড লাইন অনুসারে করা। যেখানে বলা হয়েছে, ওই বয়সের পরে নারীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই একজন নারীর বয়স ৩৫ হওয়ার আগেই ডিম্বাণু সংরক্ষণের সবচেয়ে ভালো সময়।
তবে বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাজ্যে নারীদের ক্ষেত্রে সেই বয়সটি ৩৮ ধরে পদ্ধতিটি নেওয়া হয় এবং অনেককে ৪০ বছর বয়সে তাদের ডিম্বাণু সংরক্ষণ করতে দেখা যায়।
সংসদ সদস্য চেং বলেন, সিঙ্গাপুরের নারীরাও একই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। আমরা উন্নত দেশ, আমাদের শিক্ষিত নারীরা আছেন, যাদের পেশাগত জীবন আছে এবং নিজস্ব পছন্দ আছে। আমি মনে করি বয়সের সীমা ৩৫ বছর সত্যিই খুব কঠোর হয়ে যায়। যদি একজন ৩৭ বছর বয়সী নারীর খুব ভালো ডিম্বাণু থাকে তাহলে কি আমাদের সেই নারীর ডিম্বাণু সংরক্ষণ ঠেকানো উচিত?
কিন্তু দেশটির সামাজিক ও পারিবারিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় বলেছে, বয়স সীমা আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং পেশাদার ঐক্যমতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, ৩৫ বছরে পর নারীদের ডিম্বাণুর গুণাগুন কমতে থাকে। তবে তারা বলেছে এই বয়স সীমা পর্যালোচনা করা যেতে পারে… তার জন্য চিকিৎসা ক্ষেত্রে কিছু অগ্রগতি হতে হবে যা বয়স্ক নারীদের ডিম্বাণুগুলোতেও প্রজনন ক্ষমতা আরও বেশি উর্বর থাকবে।
সূত্র: বিবিসি অনলাইন
মন্তব্য করুন