রক্তাক্ত রাজনৈতিক সংঘাতের পর শ্রীলঙ্কায় কারফিউ জারি করা হলেও সহিংসতা বন্ধ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা মঙ্গলবার রাতেও দ্বিতীয় দিনের মতো সরকারি দলের নেতাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের দমনে সশস্ত্র বাহিনীকে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ দিলেও সেনারা ছিলেন সংযত। সেনাবাহিনীকে গুলি করার অনুমতি দেওয়ার খবর অস্বীকার করেছে কর্তৃপক্ষ।

এদিকে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাজনীতিক সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে জনরোষ থেকে বাঁচতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর ছড়ালেও তা নাচক করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশটিতে ভারতের সেনা মোতায়েনের খবরও অস্বীকার করেছে দিল্লি।

সরকারবিরোধী অব্যাহত বিক্ষোভের মধ্যে লুটেরাদের গুলি করার নির্দেশ দিয়ে শ্রীলঙ্কাজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। দেশব্যাপী কারফিউ থাকা সত্ত্বেও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কলম্বোর কাছাকাছি দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে। মাহিন্দার ছেলের মালিকানাধীন একটি রিসোর্টেও অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষোভকারীরা। তবে গতকাল দিনে রাজধানী কলম্বো প্রায় জনশূন্য ছিল।

সোমবার থেকে সহিংসতায় অন্তত ৯ জন নিহত এবং দুই শতাধিক লোক আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছেন। দেশব্যাপী কারফিউর কারণে গতকাল বুধবার তৃতীয় দিনের মতো দোকান, ব্যবসা এবং অফিস বন্ধ ছিল। মেয়াদ না বাড়ালে আজ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কারফিউ চলবে। নিরাপত্তার অভাবে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠক অনলাইনে করার সিদ্ধান্ত হয়।

মঙ্গলবার দেশটির পুলিশ বলেছে, সোমবারের সহিংসতায় ৮৫টির মতো অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। হামলায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের এক এমপি, প্রাদেশিক সভার এক চেয়ারম্যান, পুলিশের এক উপপরিদর্শক এবং এক সার্জেন্ট রয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা ৪৭টি গাড়ি এবং ৩৮টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে। এ ছাড়া ৪১টি গাড়ি এবং ৬৫টি বাড়ি ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গাড়ির অধিকাংশই সাবেক মন্ত্রী বা ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের।
জনরোষের ভয়ে মাহিন্দা সোমবার রাজধানী ছেড়ে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিঙ্কোমালি শহরের একটি নৌঘাঁটিতে আশ্রয় নেন। তবে ওই নৌঘাঁটিও বিক্ষোভকারীরা ঘিরে রেখেছিলেন। এর মধ্যে মঙ্গলবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রটে যায়, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতে পালিয়েছেন মাহিন্দা। তবে শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় হাইকমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, মাহিন্দার ভারতের পালানোর খবর ভুয়া এবং সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি সত্য বিবর্জিত খবর। হাইকমিশন জোরালোভাবে এই খবর অস্বীকার করছে।

এদিকে অর্থনৈতিক সংকটকে ঘিরে বিক্ষোভ-আন্দোলনে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় সেনা পাঠানোর খবর জোরালোভাবে অস্বীকার করেছে ভারত। মঙ্গলবার স্থানীয় কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় ভারত সেনা পাঠাচ্ছে বলে দাবি করা হয়।

গতকাল শ্রীলঙ্কায় ভারতের হাইকমিশন থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই অনুমাননির্ভর খবর সম্পূর্ণ নাকচ করছে ভারত। এই ধরনের সংবাদ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ভারত সরকারের অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

দেখামাত্র গুলির নির্দেশের খবর অস্বীকার : বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্রই গুলির নির্দেশ দেওয়ার খবর অস্বীকার করেছেন দেশটির প্রতিরক্ষাপ্রধান ও সেনা কমান্ডার জেনারেল শাভেন্দ্র সিলভা। মঙ্গলবার তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের লজ্জাকর কর্মকাে জড়াবে না।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন সিলভা। তিনি সেনাবাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন। তবে সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেছেন, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন কিংবা অন্যের ক্ষতিসাধনে জড়িত ব্যক্তিদের ওপর ফাঁকা গুলি ছুড়তে তিন বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।

অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা নাকচ : সহিংসতার পরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে রাস্তায় হাজার হাজার সৈন্য থাকলেও সামরিক অভ্যুত্থানের কথা অস্বীকার করেছে সেনাবাহিনী। রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো সাঁজোয়াযানের ফুটেজ দেখিয়ে বিরোধী আইন প্রণেতা এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা অভিযোগ তুলেছেন, দেশটি আসন্ন অভ্যুত্থানের মুখোমুখি হতে পারে।

তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব কামাল গুনারত্নে এই দাবির জবাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, 'যখন দেশে একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দেয়, তখন তা মোকাবিলা করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়। কখনও ভাববেন না যে আমরা ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছি। সেনাবাহিনীর এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই। বিরোধী নেতা সজিথ প্রেমাদাসা এর আগে বলেছিলেন, অভ্যুত্থানের অজুহাত সৃষ্টির জন্য সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

বিরোধী নেতা চান চীনের সমর্থন : শ্রীলঙ্কায় চীনা রাষ্ট্রদূত কুই জেনহং এবং বিরোধীদলীয় নেতা সজিথ প্রেমাদাসার মধ্যে গতকাল বৈঠক হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুর্দশা থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য চীনের উদার সমর্থন অপরিহার্য।

ভারত মহাসাগারের দ্বীপরাষ্ট্রটিতে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য ভারত ও চীনের মধ্যে রেষারেষি রয়েছে।

নতুন সরকার গঠনের আহ্বান বিক্ষোভকারীদের :সংকটগ্রস্ত শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য একটি নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে দেশটির বিক্ষোভকারীরা ও প্রধান একটি বাণিজ্য গোষ্ঠী।

কিছু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান চাপে প্রেসিডেন্ট যদি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে সংবিধানে পার্লামেন্টের মাধ্যমে নতুন নেতা নির্বাচনের বিধান দেওয়া আছে। তাই ক্ষমতা কেন্দ্রে শূন্যতা তৈরি হবে না। পার্লামেন্টের সদস্যদের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ দেওয়ার বিধানও আছে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পোশাকশিল্প খাতের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন 'জয়েন্ট অ্যাপারেলস অ্যাসোসিয়েশন ফোরাম' দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান নন্দলাল ওয়েরাসিংহে গতকাল কলম্বোতে সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য দুই দিনের মধ্যে একটি নতুন সরকার নিয়োগ না করা হলে অর্থনীতি ধসে পড়বে এবং কেউ এটিকে বাঁচাতে পারবে না।

সূত্র : বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স, কলম্বো পেজ ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।