শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপাকসের সমর্থকদের হামলার ফলে যে অরাজক পরিস্থিতি ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল; তা প্রশমিত হচ্ছে। আন্দোলনকারীরা তাদের অহিংস অবস্থানে ফিরে গেছে। আবার হামলা করে আন্দোলনকারীদের বিক্ষুব্ধ না করে তুললে ক্ষমতাসীন দলের এমপি-নেতাদেরও জনতার হাতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে উত্তেজনা, সহিংসতা কমে এলেও বর্তমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলার উপায় নেই। মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগই শ্রীলঙ্কানদের কাছে একমাত্র সমাধান।

রাজাপাকসে পরিবার ও তাদের অনুগতরা বলছেন, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে। এটা দেশকে অরাজকতার দিকে নিয়ে যাবে। আইনজীবীরা এর জবাব খুঁজছেন। তারা সংবিধানের মধ্যে থেকে একটি আইনি কাঠামো বা প্রস্তাব দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, যার মাধ্যমে ঠিক হবে গোটাবায়ার পদত্যাগের পর কে শ্রীলঙ্কার হাল ধরবেন। তিনি সংসদের মাধ্যমে কীভাবে নির্বাচিত হবেন- সেই পথও খোঁজা হবে।

শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে স্পিকার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেওয়ারদেনা রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের অনুগত। তাই তিনি আন্দোলনকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বিকল্প নন। সংবিধানে আরও রয়েছে, সংসদ সদস্যরা একজন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। যিনি পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন।

কিন্তু সংসদে রাজাপাকসের দল শ্রীলঙ্কা পুদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) অথবা বিরোধীদের একক সংগরিষ্ঠতা নেই। এসএলপিপি ছেড়ে ৪০ জন এমপি চলে গেছেন। ফলে স্পষ্ট নয়- কার পক্ষে নতুন সরকার গঠন সম্ভব।
শ্রীলঙ্কা যদিও প্রেসিডেন্ট শাসিত দেশ; কিন্তু তার পক্ষে মন্ত্রিসভা ছাড়া দেশ শাসন সম্ভব নয়। গত সোমবার মাহিন্দার পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিসভাও বিলুপ্ত হয়েছে। গোটাবায়া শিগগির সংসদের অনুমোদনে একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারবেন- তেমন সম্ভাবনা নেই। ফলে পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলেও অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।

জনগণ ও বিরোধী দলের পদত্যাগের আহ্বান ক্রমাগত উপেক্ষা করা হলেও গোটাবায়া ও তার পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই শিথিল হচ্ছে সরকার ও দেশের ওপর। আন্দোলনকারীরাই অঘোষিত সরকারে পরিণত হচ্ছে। সাধারণ জনগণ তাদের নির্দেশনাই মান্য করছে। সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ এখন পর্যন্ত গোটাবায়ার প্রতি আনুগত্য দেখালেও তাদের অনেকেই আগের মতো কঠোর অবস্থানে নেই। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সোমবারের সহিংসতার পর আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নমনীয় আচরণ করছেন।

সোমবার বাইরে থেকে অনুগতদের কলম্বো এনে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করান মাহিন্দা। তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে আগুন দেয় আক্রান্ত আন্দোলনকারীরা। তারা ৪০ দিনের বেশি সময় ধরে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিল। শেষমেশ তাদের চোখে দুর্নীতিবাজ এমপি ও সাবেক মন্ত্রীদের ওপর তারা হামলা করেছে। সরকারের অনুগত পুলিশ কর্মকর্তারাও বাদ যাননি।

বিরোধী দলগুলো অপেক্ষায় রয়েছে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের। এর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে। কিন্তু তাদের প্রতিও জনগণের আস্থা নেই। চলমান আন্দোলনে তাদের নেতৃত্ব আন্দোলনকারী বা জনগণ কেউই গ্রহণ করেনি।
একটি ভূমিকম্পের পর যে বিধ্বস্ত অবস্থা তৈরি হয়; শ্রীলঙ্কা সে অবস্থায় রয়েছে। তবে প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে, একটি ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্ব লক্ষণ। প্রেসিডেন্ট যেভাবে প্রাসাদে জিদ ধরে পড়ে আছেন; পদত্যাগ করতে রাজিই হচ্ছেন না, তাতে আন্দোলনকারীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে বড় ভূমিকম্পটি যে কোনো সময়ে শুরু হতে পারে। তা সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে। এতে ধ্বংস হবে সোনার লঙ্কা।

লেখক :শ্রীলঙ্কার এনজিও সর্বদয়া শান্তি সেনার প্রজেক্ট ম্যানেজার