- আন্তর্জাতিক
- এক পরিবারে ধ্বংস একটি দেশ
এক পরিবারে ধ্বংস একটি দেশ

জয়ধ্বনি থেকে পতন হয়। শ্রীলঙ্কায় মাহিন্দা রাজাপাকসের ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে। গত দুই দশক ধরে তিনি দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং সর্বশেষ সোমবার পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার ভাই গোটাবায়া রাজাপাকসে এখনও প্রেসিডেন্ট। নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রধান খাতগুলোতে প্রভাব বিস্তার এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর রাজাপাকসে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক।
মাহিন্দা ক্ষমতায় থাকার সময় দীর্ঘস্থায়ী তামিল টাইগার বিদ্রোহের নির্মম পরাজয় ঘটে। পরের বছরগুলোতে আধা-স্বৈরাচারী মুকুটবিহীন রাজা হিসেবে দেশ শাসন করেছেন তিনি। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের ভোটের প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার পরাজয় রাজনৈতিক ভাটার সংকেত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ভয়াবহ ইস্টার সানডে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন তিনি। তখন তিনি কথিত জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তবে এখন তাদের আধিপত্যের যুগ শেষ হতে চলেছে বলেই মনে হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা স্বাধীন হওয়ার পর বর্তমানে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ম্ফীতি, সরকারি ঋণের বিশালতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার কোষাগার খালি করাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশটি মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করতে পারছে না। খাদ্য ও জ্বালানির দাম আকাশচুম্বী। বিদ্যুৎ বিপর্যয় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করেছে। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি প্রবল। অনেকে শ্রীলঙ্কার হাসপাতালের পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনা করছেন।
কয়েক সপ্তাহের গণবিক্ষোভের পাশাপাশি সোমবার রাজপথে ব্যাপক সহিংসতার পরে মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার আত্মসমর্পণ এক মাসের ব্যবধানে তার পরিবারের চতুর্থ সদস্যকে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পদ থেকে বিদায় দিয়েছে। তার ভাই বাসিল এবং চামল যথাক্রমে অর্থ ও সেচমন্ত্রী ছিলেন। মাহিন্দার পুত্র নমল ছিলেন ক্রীড়ামন্ত্রী। স্বজনপ্রীতির ফলে এখন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়ার পদত্যাগের দাবিতে দ্বীপরাষ্ট্রটি উত্তাল।
বিশ্নেষকরা বলছেন, দেশের নেতৃত্বকে ঘিরে এই অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের যে কোনো সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলছে। কলম্বোতে সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক পাইকিয়াসোথি সারাভানামুত্তু বলেছেন, কোনো কিছু ঘটার আগেই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সমাধান করতে হবে। প্রেসিডেন্ট পদ এই মুহূর্তে একটি বিষাক্ত নাম।
এই বিষের বেশিরভাগই তার পরিবারের দোষ। এর মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক এবং নথিভুক্ত অভিযোগ রয়েছে। তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর হামলার চূড়ান্ত পর্যায়ে হাজার হাজার বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ বছরের পর বছর সহিংসতা এবং ভয়ভীতি ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। জাতিগত-ধর্মীয় উত্তেজনা বেড়েছে। চরমপন্থি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আদেশে দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে। তারপর ছিল তাদের অর্থনীতির অব্যবস্থাপনা। রাজাপাকসে শান্তিকালীন সময়েও সামরিক বাহিনীর বাজেট বড় করেছেন এবং এক ধরনের ক্রনি পুঁজিবাদে জড়িয়ে পড়েন যা তার পরিবারের সম্পদ বাড়িয়েছে। তারা চীনা ঋণে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিয়েছেন। তাদের পারিবারিক এলাকা হাম্বানটোটাতে একটি বন্দর বানিয়েছেন যা শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়।
ফরেন পলিসিতে অমিতা অরুদপ্রগাসম লিখেছেন, কোনো পর্যবেক্ষক এখন আর বিশ্বাস করে না যে দেশটি আগামী পাঁচ বছরে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হবে। এই বছর দেশটির ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করার কথা থাকলেও তার কোনো সম্ভাবনা নেই। দুর্নীতির অভিযোগে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠছে। দেশটির দেউলিয়া অবস্থার জন্য জনগণ এই পরিবারকে দায়ী করছেন।
মন্তব্য করুন