গত ২৫ জুন ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ লা গ্যালারিতে শেষ হলো শিল্পী সব্যসাচী হাজরার 'ব্রাহ্মী থেকে বাংলা' শীর্ষক প্রদর্শনীটি। নিঃসন্দেহে প্রদর্শনীটিতে দর্শকের উপস্থিতি ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। প্রচারের দিকটিও সেদিক থেকে এগিয়েই ছিল। আকর্ষণের কারণ কী? শিল্পী কী অনুসন্ধান করেছেন, তা জানা নাকি লেখক ও পাঠকপ্রিয় প্রচ্ছদশিল্পী সব্যসাচী হাজরার সঙ্গে সাক্ষাৎ? হতে পারে এর যে কোনো একটি বা দুটিই। কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে দর্শক হিসেবে আমাদের প্রকরণের সঙ্গে এই ধরনের অনসন্ধিৎসু কাজের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে থাকে। সব্যসাচী কী ধরনের অনুসন্ধান চালিয়েছেন? এর উত্তর পাওয়া যায় এই প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত বই 'ইন দ্য কোয়েস্ট অব টাইপোগ্রাফি' শিরোনামে। প্রশ্ন হলো, এই অনুসন্ধান কতটা নতুন এবং প্রাসঙ্গিক? টাইপের সম্পর্কটা ছাপাখানার ইতিহাসের সঙ্গে। হরফের একটি নির্দিষ্ট 'টাইপ' বই ছাপানোর কাজে যখনই ব্যবহার হচ্ছে, তখনই শুরু হচ্ছে টাইপোগ্রাফির যাত্রা। তার মানে টাইপোগ্রাফির ইতিহাস ছাপাখানার ইতিহাসের সমবয়সী। তাহলে সব্যসাচী কেন আবার ২০২২ সালে টাইপোগ্রাফির অনুসন্ধানে নামেন?
সব্যসাচী হাজরা :"আজকে (২৫ জুন, ২০২২) গুগলে সার্চ করছিলাম, এসথেটিক্যালি বিউটিফুল টপ টেন অ্যালফাবেট। দশটার মধ্যে বাংলা নাই। পনেরোটার মধ্যে বাংলা নাই। পঁচিশটার পরে আমি আর সার্চ দিইনি। তার মানে কী, বড় একটা অংশ এখনও জানে না এর সম্ভাবনার কথা। বাংলা হরফ কোনো ভুঁইফোঁড় জায়গা না। এটা অনেক আদি একটা ভাষা থেকে আস্তে আস্তে আজকের জায়গায় এসেছে। আমাদের নিজস্ব অ্যালফাবেট আছে। আমাদের ব্যাকরণ আছে। আমাদের পরিভাষা আছে। আমাদের এই ভাষা থেকে উদ্ভূত ভাষা আছে। সুতরাং এই জায়গার জার্নিটা অনেক বড়।"
তাহলে সব্যসাচী বাংলা ভাষাকে দেখতে চান একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে। যে প্ল্যাটফর্মে তিনি বাংলা ভাষার হরফকে খুঁজে পাচ্ছেন না। অথচ তিনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে এই টাইপোগ্রাফি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। বলা যায়, সব্যসাচীর এই অনুসন্ধিৎসার জন্ম তার শৈল্পিক সত্তা থেকেই, যেখানে তিনি নিজস্ব ধরন বা শৈলী তৈরিতে আগ্রহী। এই আগ্রহের কারণেই ক্রমাগত হরফের বাহ্যিক অবয়ব থেকে হরফের অ্যানাটমির দিকে অগ্রসর হয়েছেন। এই অ্যানাটমিকে দেখতে সাহায্য করেছে আবার ডিজিটাল মিডিয়ার অভিজ্ঞতা। যেখানে শিল্পী পিপেল থেকে পূর্ণাঙ্গ ফর্ম নির্মাণের প্রকরণটির সঙ্গে যুক্ত থাকেন। এই পথেই শিল্পী আবিস্কার করেন বাংলা ভাষার হরফ, যার নির্মাণের ইতিহাস ভঙ্গুর। বাংলা ভাষার আন্দোলনের ইতিহাস আছে; কিন্তু এই ভাষার হরফের ইতিহাস নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই, নেই কোনো সংরক্ষণ প্রবণতা।
সব্যসাচী :"আমার কাছে এগুলো কোনো সুখকর কাজ না। কাজগুলো করতে আসলেই কষ্ট হয়। এগুলোর পেছনে কোনো টাকার গল্প থাকে না। ম্যানপাওয়ার পাওয়া যায় না। কেউ প্যাট্রন করতে চায় না, কেউ সাহায্য করতে চায় না। আমি করি; আমার একটা দায় আছে। আমার খালি মনে হয়, আমি যে সাফারিংসের মধ্য দিয়ে গেছি, পরবর্তী প্রজন্মের কেউ যদি কাজটা করতে চায়, আমি চাই, সে যাতে কোনো সাফারিংসের মধ্য দিয়ে না যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমি আমার কাজ করার সময় অনেক ভালো কাজের নমুনা, অনেক কাজের সুবিধাজনক জায়গা- এগুলো হাতের কাছে পাইনি। আমি যখন ওই জিনিসটা খুঁজে পেয়েছি, তখন মনে হয়েছে এটা যদি কারও সামান্য কাজে লাগে; আমার লুকায়া রাখার তো কিছু নেই। বা একটা জিনিস আমি পেয়েছি, সেটা দিয়ে অনেক দূর যেতে পারি। সেটা যদি আমি ওপেন করতে পারি, তাহলে একটা তরুণ ছেলে যদি ওইটা দেখে, ও অনেক দূর এগোতে পারবে। সুতরাং এটা ওপেন করে দেওয়া ভালো। আর্ট এমন একটা জিনিস, আমার কাছে মনে হয়, এটা ইচ্ছে করেও লুকায়া রাখা যায় না। এটা ওপেন করা সবচাইতে সহজ, সবচাইতে সাধারণ এবং সবচাইতে সৎ প্রক্রিয়া। বইয়ের মধ্যে কিছু অন্য জিনিস ঢুকছে; যেমন- শেষের চ্যাপ্টারে বিভিন্ন সময়ের কালোত্তীর্ণ কিছু কাজ আছে। তার মধ্যে আমার কোনো কাজ নাই। এই কালোত্তীর্ণ কাজগুলো আনা কেন? কারণ আমরা আমাদের সময়কার অথবা বিগত সময়কার এই কাজগুলোরে হেলাফেলা হিসেবে নিছি। আমরা খালেদ চৌধুরীর কাজ প্রিজার্ভ করতে পারি নাই, প্রাণেশ মণ্ডল পারি নাই, দেবদাস চক্রবর্ত্তী পারি নাই, কামরুল হাসান পারি নাই। অসংখ্য 'পারি নাই'। আজকে যদি এই কাজগুলো নূ্যনতম পর্যায়েও বাংলা একাডেমি বা শিল্পকলা একাডেমি প্রিজার্ভ না করে, থাকবে না।"
গুগল সার্চে বাংলা হরফ নিয়ে যাঁদের লেখা এখনও প্রাসঙ্গিক, তাঁরা বাংলা ভাষার কেউ নন জাতিগত দিক বিবেচনায়। এখনও তাঁরাই জারি রেখেছেন বাংলা হরফের ইতিহাস। কাজ করছেন। লিখছেন। তাতে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রেক্ষাপটে ছাপাখানায় বাংলার যে হরফ তৈরি হয়েছিল, তারই ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। ফল দাঁড়াচ্ছে, অন্য সকল প্রযুক্তির মতো- ভাষার হরফগুলোও আমরা ব্যবহার করছি; কিন্তু এর কাঠামো ও নন্দনতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত আমাদের নয়। ফলে মাতৃভাষার হরফেরও আমরা ভোক্তা কেবল, নির্মাতা নই। সব্যসাচীর প্রদর্শনী এই প্রশ্নকে আবার নতুন করে সামনে আনে এবং প্রশ্ন উত্থাপন করে; দাবি করে তদন্ত- এই পরিণতি ও বাস্তবতার কারণ কী? ভাষা জাদুঘর; ভাষা বলতে কী বুঝবে? বাংলা একাডেমি হরফের ইতিহাসকে কীভাবে দেখে? উন্নয়নের জন্য ভোক্তা, না নির্মাতা, কোনটি হয়ে ওঠা আমাদের জরুরি?
সব্যসাচীর আয়োজনে প্রদর্শনী না বই, কে কার জন্য উপস্থিত?
সব্যসাচী :"প্রথম থেকে একটা ভুল হচ্ছিল খুব। সবাই ভাবছে, এই এপিবিশনটা হচ্ছে মূল। এপিবিশনটা মূল না। এপিবিশনটা হচ্ছে পরে। বইটা হচ্ছে আগে। বইয়ে যে জার্নির মধ্য দিয়ে গেছি, আমার মনে হয়েছিল যে, সবাই বইটা নেবে না। এর একটা একাডেমিক চেহারা হয়তো তৈরি হয়েছে ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও। এখন যে এই চর্চার মধ্যে নাই, এই এপিবিশনটা দেখে সে যেন আমার জার্নিটা বুঝতে পারে। আবার যে বইয়ের জার্নিতেও নাই, যে এপিবিশনের জার্নিতেও নাই, সে হয়তো ভিজুয়াল কিছু জিনিস দেখলে তার মধ্যে কোনো একটা জায়গা আন্দোলিত হতে পারে যে, বাংলা হরফের এই জায়গাটা আমার পছন্দ। তো ঠিক আছে, এই জায়গাটায় সে নক করুক। কারণ, আমি জানি এই মুহূর্তে মানুষের বই পড়া, এপিবিশন দেখা কষ্টকর হয়ে দাঁড়াইছে, কেন জানি। সুতরাং যদি ভিজুয়াল জিনিসগুলো থাকে, তাহলে হয়তো কমিউনিকেট করতে পারবে। বইটার একটা বড় সমস্যা ছিল ভাষা। কেন ইংরেজিতে, কেন বাংলায় না ইত্যাদি। আমি আসলে বাংলা ভাষার জায়গা থেকে একেবারেই হতাশ না। যতটুকু বাংলা অক্ষরের মধ্যে ঢুকছি, মনে হয়েছে, নান্দনিকভাবে এটা খুবই শক্তিশালী একটা জায়গা। ফলে, এটা শুধু আমাদের সম্পদ, আমাদের সম্পদ বলে তো থাকতে পারে না। আমার আসলে বাঙালিদের থেকে অন্যদের বেশি জানানো জরুরি মনে হয়েছে। আমার হরফের গল্প ওদেরকে জানাতে হবে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করছে, এটার ইতিহাস কি এই? আমি বলি, না। আমি ইতিহাসবিদ না। আমি একটা প্রমিতকরণের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেয়েছি। তার জন্য আমার যতটুকু দরকার হয়েছে, ততটুকুই নিয়েছি। আর্টিস্ট হিসেবে না। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড চারুকলা এবং অক্ষরবিন্যাস নিয়ে বেশ কিছুদিন নিজে কাজ করার চেষ্টা করছি। যতটুকুই কাজ হয়েছে, ততটুকুতে যে সার্চিংয়ের মধ্য দিয়ে গেছি, তাতে করে আমার মনে হয়েছে, একটা প্রমিত ভাষা অন্তত আমাদের থাকা উচিত। আজকের স্কুলের যে ছেলেমেয়েটা প্রথম অক্ষর লেখাঙ্কন করবে, কোন নমুনায় করবে? সে জায়গা থেকে একটা প্রমিত হরফ সাজেস্ট করা এবং একটা লিখন পদ্ধতি সাজেস্ট করা- যে হ্যাঁ, এভাবে বাংলা হরফ লিখা যায়। বইটা করতে গিয়ে যে মূল ঝামেলায় পড়েছিলাম- এত তথ্য উপাত্তের অভাব! খুব কমন জিনিস যে, এই পত্রিকার এটা কার ডিজাইন! একজন বলতেছে অমুক, একজন বলতেছে তমুক। আমি কোনোটাই নিতে পারি নাই। সুতরাং তথ্য-উপাত্তের একটা বড় অভাব এই বইয়ের মধ্যে থেকে গেছে। এই জিনিস যদি আজকেও প্রিজার্ভ না হয়, আমি কীভাবে পরবর্তী সময়ে বলব, আমার গ্রামোফোন রেকর্ডের কাভার, আমার বুক কাভার, আমার বাহন লিপি- যেগুলো আমরা যাতায়াতের পথে দেখি, আমার সিনেমার পোস্টার, টাইটেল ডিজাইন- এগুলোর কথা? এত ভালো ভালো নমুনার কাজ আছে, অথচ এখনকার যে ছেলেটা টাইপোগ্রাফি নিয়ে চর্চা করে, ওর কাছে কোনো নমুনা নাই। ও তখন একদম ওয়ান-টু থেকে শুরু করে। কিন্তু ওর আগেও যে একশ কাজ হয়ে গেছে বা এই ব্যাপারটাতে যে আমরা খুব স্কিলড ছিলাম, এই জিনিসটার কোনো নমুনার খোঁজ ওর কাছে থাকে না। "
প্রদর্শনীতে এমন সব উপকরণ নিয়ে বিশেষ সচেতনতা লক্ষণীয়, যা মূলত হাতে লেখার জন্য প্রযোজ্য। ছাপার ইতিহাসের পথ ধরে এবং ছাপার হরফের বিভিন্ন আকার নিয়ে নিরীক্ষা চালিয়ে সব্যসাচী যেখানে একটি প্রমিত হরফ প্রস্তাব করতে চাইছেন, সেখানে কেন তিনি আবার সেই ফন্ট নিয়ে হাতে তৈরি উপকরণেও নিরীক্ষায় আগ্রহী? একই হরফকে তিনি লেখাঙ্কন এবং ছাপা দুই দিকেই রাখতে চাইছেন। এই প্রবণতার সঙ্গে তাঁর শিল্পসত্তার আভাস পাওয়া যায়। ক্যানভাস থেকে প্রচ্ছদ শিল্পে, বয়ান থেকে প্রতীকে ভ্রমণের ফলাফল হিসেবে দেখা যায়, তাঁর পূর্বের 'চিত্রভাষা' বইটিকে। এই চিত্রভাষাকেই যেন কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বর্তমান প্রদর্শনীতে। যা একদিকে যথাযথ কলমের রূপ সন্ধান করছে, অন্যদিকে টাইপফেস। আর 'সব্যসাচী টাইপফেস' এই দুই বিদ্যমান ক্ষেত্রের জন্যই সম্ভাবনাময় প্রস্তাবনা।
সব্যসাচী :"আমি বইয়ের এক জায়গায় লিখছি যে, বাংলা ক্যালিগ্রাফি টেবিলে বসে হবে না। আসন করে বসতে হবে, পিঠ সোজা রাখতে হবে, হাত সোজা করে সামনের দিকে রাখতে হবে। এটা নিচে বসে লেখার পদ্ধতি। হাত ভাঁজ করে ফেললে বাংলা ক্যালিগ্রাফি করা যাবে না। টাইপোগ্রাফি পারবে। কিন্তু বাচ্চারা যে ক্যালিগ্রাফি করবে, ওর সোজা হয়ে বসতে হবে। হাত সোজা রেখে যখন কনুইয়ের মুভমেন্টকে কাজে লাগিয়ে লিখবে, তখন তার পরিধি বড় থাকবে। ভাঁজে মুভমেন্ট কমে আসে, পরিধি ছোট হয়ে যায়। অ্যারাবিক ক্যালিগ্রাফির প্রধান ধরন হচ্ছে- ওরা দাঁড়ায়, টেবিল থাকে- এভাবে শুরু করে। ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে মুহূর্তে তৈরি হওয়া লেখা-অঙ্কন। হাত ও শরীরের তাৎক্ষণিক বৈশিষ্ট্য এর সঙ্গে জড়িত। মুহূর্তে তৈরি হওয়া শিল্প। এটাই ক্যালিগ্রাফি। লেখাঙ্কন শব্দটা দিয়েছিলেন নন্দলাল বসু। লেখার উপকরণ-সূত্র হিসেবে আমি যা পেয়েছি, সব বাম দিকে ত্যারচা করে কাটা। আমাদের বলা হচ্ছে, ওইটা দিয়ে বাংলা লেখা সম্ভব। আমি তো লিখতে পারছি না। আমার কাছে মনে হয়েছে, কাট-নিব এ রকম না, কাট-নিব হতে হবে ডান দিকে কাটা। কাটার উঁচু অংশটা বাম দিকে, নিচু অংশটা থাকে ডান দিকে। কোথাও এই সাজেশন নাই যে, এই কাট-নিবটাই বাংলা লেখার জন্য পারফেক্ট। এই নিবটা চায়নাতে আমরা পাঠাইছি যে, একই নিবটা ফাউন্টেন পেনের মতো তৈরি করে দেবে। এটা একটা ছোট্ট মেথড। একটা পেন সাজেস্ট করবে, কোনটা শিশুর হাতে দেব। আমরা শিশুদের জিজ্ঞেস করলাম, আইসক্রিমের কাঠি আছে? ওদের সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ানো হলো। বলা হলো, ওটা না ফেলতে। প্রায় ৮০ জন শিশু। ৬০টা কাঠি রাখছে। কাঠিটাকে আমি কেটে দিছি। এইবার আলতা আছে, লেখা শুরু কর। আমি কীভাবে লিখতে হবে, দেখায়া দেব। বিশ্বাস হবে না, আধা ঘণ্টার মধ্যে প্রতিটি বাচ্চা ই-এর যে টানটা দিছে; একদম পারফেক্ট। কোনো ভুল নাই। ওইটার একটা ডকুমেন্টেশন আছে।"
প্রদর্শনীতে ওই ডকু নেই কেন?
সব্যসাচী : "এটা দিলে সব গুলিয়ে যাবে। ওইটা একদম প্র্যাকটিক্যাল জায়গা। দুইটা, ইনফ্যাক্ট তিনটা পার্ট ছিল। এটার পরে যেটা আছে টোটালটাই প্র্যাকটিক্যাল। গ্যালারিজুড়ে সে প্রসেসটাই তখন থাকবে। একদম লেখনী, মুদ্রিত হরফ- ছাপা, ম্যাটেরিয়াল- এইসব। এগুলো এখানে দিলে ফোকাস থাকবে না।"
তাহলে এটা হরফ নিয়ে কাজের পরিকল্পনার প্রথম প্রদর্শনী?
সব্যসাচী :"হ্যাঁ। প্র্যাকটিক্যাল জায়গাটা হবে পরবর্তী পর্যায়ে। ওইটা রেডি করতে ভয়াবহ ঝামেলা আছে। পুরান ঢাকায় একটা সোর্সিং পাওয়া গেছে। সাড়ে চারশ ক্যারেক্টার বানানোর টাকা কে দেবে?"
'সব্যসাচী টাইপফেস'-এর মৌলিকত্ব বা বৈশিষ্ট্য?
সব্যসাচী :"প্রদর্শনীতে যে বিবর্তন দেখিয়েছি ... শুরুতে মাত্রা ছিল না। আস্তে আস্তে মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। আগে ছিল হাতের লেখা পুঁথিতে, শিলালিপিতে। এর পরে যখন আমাদের হরফ 'চায়না ইলাস্ট্রাটা'-তে ছাপা হয়েছে, তখন থেকে দেখা যাবে মাত্রার সঙ্গে সংযুক্ত, মাত্রার সঙ্গে কিছুটা সংযুক্ত, সংযুক্ত এভাবে এগিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যে দুইটা ফন্ট লেখার জন্য ব্যবহার করি, তা তো মাত্রার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। মাত্রার সঙ্গে সংযুক্তি বাদ দিলাম কেন? আমি বলছি যে, শুধু হরাইজন্টাল-ভার্টিক্যাল লাইন দিয়ে না, 'অ' মাত্রার সাথে এভাবে (সব্যসাচী টাইপফেস) সংযুক্ত থাকবে। আর না হলে অক্ষরের বিউটি নষ্ট হয়। যেমন- সুতন্বি বা টেঙ্গনের 'ক'- তে একটা ভাঁজ ফেলছে, ব্যাখ্যা কী? আমাকে ভুলটা ধরিয়ে দিলে আমি সেই ব্যাখ্যায় যেতে রাজি আছি। এখানে ভাঁজ করার কথা না। আমাদের ইতিহাস সেটা বলে না। এই সৌন্দর্য দেখার ক্ষেত্রে আমার চারুকলা ব্যাকগ্রাউন্ড কাজ করছে। এভাবে সাড়ে চারশ ক্যারেক্টার তিন মাসে তৈরি করা আছে। আমাদের বাংলা হরফ টেঙ্গন ও ইউনিকোডের মতো প্রস্তুত করার জন্য সাড়ে চারশ করা লাগে। সংস্কৃত-এর লাগত সাড়ে ছয়শ। আমি এই জায়গাটা টাচ করতে চাইছি যে, বাংলা হরফের যে চিকন-মোটা হওয়ার প্রবণতা- এটা অক্ষরের মধ্যে একটা ব্যঞ্জনা তৈরি করে। (টেঙ্গন, ইউনিকোড ও সব্যসাচী টাইপফেস পাশাপাশি রেখে বলেন) আমারটা দেখতে একটু বেঢপ লাগছে; কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আমার গ্রামার এটাই করছে। কেউ যদি বলে 'না, ব-এর এটা সোজা করাটা হইলো না।' কোনো সমস্যা নাই। আমাকে ব্যাখ্যা দিলে আমি সোজা করব। আমার মূল জায়গা হলো, প্রমিত-তে পৌঁছাইতে হবে। ইচ্ছে করলেই যেন কেউ পরিবর্তন করতে না পারে, হরফের মূল বৈশিষ্ট্য। রেখা মোটা-চিকন-মোটা এভাবে এগোয়। এটা এমনি এমনি আনিনি। হাজার বছরের ইতিহাস। আমাদের অক্ষরের মধ্যে একটা থ্রিডি ব্যাপার আছে। এটাই আমাদের অক্ষরের মজা।"
ছাপার ইতিহাস থেকেই সব্যসাচীর কাজের আরম্ভ। বাংলাদেশে হরফ নিয়ে আরও কয়েকজন কাজ করেছেন। তার মধ্যে বিদেশির সংখ্যা অনুপাত বেশি না কম, তার চেয়েও বেশি বিবেচ্য বিষয় বোধ হয়, সেই ইতিহাসের ধারাবাহিক একটা দলিল আগে যেমন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মতো প্রতিষ্ঠান রক্ষা করেছে, এখন ফিওনা রস থেকে জ্যাকব থমস, যারা কাজ করছেন, তাদের প্রচেষ্টাও সেই সূত্র ধরে খুঁজে পাওয়া যাবে। যার মধ্যে বায়ান্নর উত্তরসূরিরা নেই। সব্যসাচী সেই অভাব থেকে মূলত 'সব্যসাচী টাইপফেস'-এর অজুহাতে প্রস্তাব করেন একটি দলিল নির্মাণের, যা আমাদের ভবিষ্যৎ জাতিগত গ্লানি থেকে মুক্ত করবে। এবং একটি ধারাবাহিক অনুসন্ধানের পথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্দীপনা জোগাবে। তারপরও প্রশ্ন- এই প্রদর্শনীর প্রবণতাটি ঔপনিবেশিক ভাষা রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ে কি?
সব্যসাচী :"ঢুকে পড়ে। কিন্তু আমি তো ভাষাবিদ না। আমি ওই লাইনে যাইতেই চাই নাই। আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন মানুষ সে যদি ব্রিটিশ বা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে এসে কিছু কাজ করে, কাজটা এগোয় দেয়- তা তো আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তাই ঔপনিবেশিক ভাষার ইয়েতে আমি যাইনি। কারণ, ওই জায়গাটা আমি বুঝতেই পারি না। আমি শুধু হরফের নান্দনিক জায়গাটা নিয়েই চিন্তা করেছি। তার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুর ইতিহাস এখানে নিয়েছি। আমার বইয়ের ভুল ধরলে, আমি শুধরায়ে নিব, আমি সেই ঘাটতি পূরণ করব। আমি কোনো ফুলস্টপ দিইনি। যে কেউ কন্টিনিউ করতে পারে। দরকার হলে আরেকটা বই হোক। আমি সেটার সঙ্গেও থাকতে রাজি আছি, যদি কোনো হেলপ লাগে। কিন্তু একজন যে কাজই করুক, তা যেন পরবর্তী মানুষদের আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যায়।"