ভারতের রাজনীতিবিদদের মধ্যে সততার বিচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একসময় রাখা হতো আদর্শ উদাহরণ হিসেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পর চিটফান্ড কেলেঙ্কারি , কয়লা পাচার, গরু পাচার, শিক্ষক নিয়োগ, টেন্ডার দুর্নীতি, অর্থ পাচার , সোনা পাচারের মতো ঘটনায় তার নামও জড়ায়। 

এ ছাড়া তার পরিবার ও তার দলের ছোট বড় একাধিক নেতা ও মন্ত্রী, বিধায়ক, সংসদ সদস্যের নামও আসে। একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাশীল দল তৃণমূল কংগ্রেসের ভাবমূর্তি যখন চরম সংকটে, ঠিক তখন স্রোতের বিপরীতে হেঁটে দলের জন্য আশার আলো হয়ে উঠছেন মাঠপর্যায়ের বেশকিছু কর্মী।  

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার দুর্গাপুরে ভাঙাচোরা জরাজীর্ণ মাটির ঘর, প্রবল বৃষ্টিতে খড়ের ছাউনি চুইয়ে টিপটিপ করে পড়ে পানি। এই বাড়ির মালিক সাদামাটা বর্গাচাষী আদিবাসী এক নারী। বর্গা চাষ করেই চালান সংসার। তবে মানুষের বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া তার কাজ। জনতাকে পরিষেবা দিতে গ্রামের কাঁচা-পাকা রাস্তা ধরে নিয়মিত কয়েক কিলোমিটার সাইকেলে চালিয়ে যান পঞ্চায়েত অফিসে। বলছি তৃণমূল পরিচালিত মলানদিঘি গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান রানী মুর্মুর কথা। 

কাঁকসার মলানদিঘি মোলডাঙ্গা আদিবাসী পাড়ার আদিবাসী ষাটোর্ধ্ব মুর্মুকে এলাকার উন্নয়নের জন্য ভোটাররা নির্বাচিত করেছিলেন। দায়িত্বভার গ্রহণের পরদিন থেকেই সেই কাজ শুরু করেন। প্রতিদিন ভোরে উঠে ৩কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যান পরের জমিতে চাষের কাজ করতে। কাজ সেরে সরাসরি আসেন পঞ্চায়েত অফিসে। শোনেন গ্রামের মানুষের অভাব ও অভিযোগের কথা, সমাধানও করেন দ্রুত। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা বা রাজ্য সরকারের গীতাঞ্জলি আবাস যোজনা প্রকল্পে গ্রামের মানুষকে শতাধিক বাড়ি পাইয়ে দিলেও নিজে এখনো থাকেন মাটির ঘরেই। 

নিজের ঘর নিয়ে প্রশ্ন করতেই মুর্মুর স্পষ্ট জবাব, এলাকার মানুষের আগে পাকা বাড়ি হোক, তারপর না হয়...। 

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে সাইকেল চালিয়ে পরের জমিতে কাজ করতে যান মুর্মু।

আর তাই হয়তো রাজ্যে তৃণমূল নেতাদের নানান দুর্নীতির খবরের প্রভাব পড়েনি কাঁকসার মলানদিঘি মোলডাঙ্গা আদিবাসী পাড়ার। গ্রামবাসীরা বলছেন, আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা ফের দুর্নীতিমুক্ত উপপ্রধান রানী মুর্মুকে চাইছেন। 

এদিকে পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমরি ১ নম্বর ব্লকের দলুইবাজার ২ গ্রাম পঞ্চায়েত- ‍শুধু ব্যতিক্রমী উদাহরণ নয়়, রাজনীতিবিদদের কাছে অনন্য দৃষ্টান্তও এই পঞ্চায়েতের পঞ্চায়েত প্রধান আদিবাসী নারী ঝুমা কোড়া। মাটির দেয়াল আর খড়ের চালার দু’কুটুরি ঘরে বসবাস করা ঝুমার স্বপ্নটা অবশ্য দুর্নীতির টাকায় গাড়ি-বাড়ি করে বদনামের অংশীদার হওয়া নয়। বরং পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে পাওয়া অনুদানের অর্থ দিয়ে আরও পড়াশুনা করে স্নাতক পাস করা। স্নাতক পাস করে একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করে সম্মানের সঙ্গে বাকি জীবন কাটানো। 

মেমারির দুলুইবার ২ পঞ্চায়েত এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম চোঁয়াডাঙা। এই গ্রামেরই ৬ নম্বর সংসদের আদিবাসী মহল্লার বাসিন্দা ঝুমা। তাঁর স্বামী সঞ্জয় কোড়া চাষের মৌসুমে পরিবারের দেড় বিঘা জমি ও অন্যের কাছ থেকে ভাগে নেওয়া ২-৩ বিঘা জমি চাষ করেন। চাষের মৌসুম বাদে অন্য সময়ে সঞ্জয় বালি খাদানে শ্রমিকের কাজ করেন। চোঁয়াডাঙা গ্রামের আদিবাসী মহল্লায় থাকা ঘরে সঞ্জয় কোড়া তাঁর বৃদ্ধা মা লক্ষ্মীদেবী, স্ত্রী ঝুমা এবং তাঁদের দুই সন্তান সুস্মিতা ও হিমাংশুকে নিয়ে থাকেন। ঝুমার কন্যা সুস্মিতা পাল্লারোড গার্লস স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। আর ছেলে হিমাংশু স্থানীয় কলানবগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।  কোনরকম বিলাসিতা নয়, দিন আনি দিন খাওয়াতেই স্বাচ্ছন্দে দিন গুজরান চলছে কোড়া পরিবারের।  

ঝুমা বলছিলেন, স্কুলজীবন থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাতৃভক্তি ও লড়াই সংগ্রামের বিষয়টি দাগ কাটে তার মনে। তারপর থেকে মনে প্রাণে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর একান্ত ভক্ত হয়ে ওঠা এবং তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তাঁর সঙ্গে একই গ্রামের যুবক সঞ্জয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। তারপর নিজের সংসারের হাল ধরার জন্য তিনিও খেতমজুর হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর তাঁর স্বামী বালি খাদানে শ্রমিকের কাজ করা শুরু করেন। 

সংসার সামলিয়ে রাজনীতি ও পড়াশোনার পাশাপাশি ‍কৃষিকাজে স্বামীকে সাহায্য করেন ঝুমা। 

দু’জনের সামান্য রোজগারে কোনরকমে তাঁদের সংসার চলতো। সংসারে অভাব থাকায় বিয়ের পর তিনি আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। এরই মধ্যে রাজ্য রাজনীতিতে পালাবদল ঘটে। ২০১৩সালে প্রথমবার পঞ্চায়েত ভোটে জয় লাভ করে তিনি পঞ্চায়েতের সাধারণ সদস্য হন। এরপর ২০১৮ সালে আবারও ভোটে জিতলে নেতারা তাকে পঞ্চায়েত প্রধানের দায়িত্ব দেন।  

পঞ্চায়েত প্রধান ঝুমা জানান, রবীন্দ্র মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পড়াশোনা করে ২০২১ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেছেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এখন উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করছেন। প্রত্যেক সপ্তাহের শনি ও রোববার ক্লাস করতে যান। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর স্নাতক স্তরের পরীক্ষা দিয়েও তিনি পাস করতে চান। প্রধান হয়েও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি স্বামীকে চাষের কাজে সহযোগিতা করেন। খেত মজুরির কাজেও তাঁর অনীহা নেই। 

ঝুমা জানান, তাঁর স্বপ্ন সরকারি চাকরি করা। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী সরকার যদি তাঁকে যেকোনো একটি পদে চাকরির ব্যবস্থা করে তাহলে তিনি বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। দুর্নীতি করে বিলাসি জীবন নয়, নিজের যোগ্যতা বলে একটা চাকরি নিয়ে যেন সাদামাটা জীবন ও সংসার চালাতে পারেন- সেটাই তাঁর কাছে অনেক বড় বলে জানান তিনি।