পেছনে ফেরা যাক। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইরানের তেহরানে ১০ থেকে ২০ লাখ মানুষ রেজা শাহ পাহলভির পদত্যাগ দাবিতে শান্তিপূর্ণ পদযাত্রায় অংশ নেয়। ওই সময় শহরের প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মানুষ সড়কে নেমে আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআই সতর্কভাবে তা পর্যবেক্ষণ করছিল। কারণ, তখন ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং তাদের অস্ত্রের ক্রেতা। সে সময়কার আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি ছিলেন; আন্দোলনে সমর্থন ও পথনির্দেশনা দিয়েছিলেন, তিনি হলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি। সে সময় তিনি হাজার মাইল দূরে প্যারিসে নির্বাসিত ছিলেন। যদিও পদযাত্রায় মানুষ তাঁর ছবি বহন করছিল।

সেই খোমেনির দল কয়েক দশক পর এখনও ইরানের ক্ষমতায়। এখন আবার ইরানের রাজধানী তেহরান ও অন্যান্য শহরে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। ২২ বছর বয়সী মাহশা আমিনিকে ইরানের পুলিশ হিজাব আইন ভঙ্গের দায়ে গ্রেপ্তার করে, যে হিজাব খোমেনির শাসনামলে ১৯৮১ সালে শুরু হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশি হেফাজতে তাঁর মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই মানুষ বিক্ষোভ করছে। নারীরা তাদের হিজাব আগুনে পোড়াচ্ছে; ক্ষমতাসীনদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে; পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানকার অস্থিরতার তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে।

অনেকেই যেমনটা আশা করছেন, তাহলে কি এই গণবিক্ষোভে অবশেষে ইরানে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে? কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সেখানে বারুদ জ্বলে উঠেছে। নারীর প্রতি নিপীড়ন বর্তমান শাসনের একটি বিদ্যমান বাস্তবতা। সম্ভবত সেটি মৌলিক দুর্বলতাও বটে। সেখানকার আন্দোলনের যেসব ছবি আমাদের ফেসবুক ও টুইটারে ঘুরছে এবং সেগুলো যেভাবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আসছে, তাতে মনে হয়, তারা সঠিক।

তাহলে কি ইতিহাস নিজেকেই পুনরাবৃত্তি করছে? নিঃসন্দেহে অনেক প্রতিবাদী এমনকি ১৯৭৯ সালের আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন :'অত্যাচারীদের মৃত্যু; তিনি শাহ-ই হোন কিংবা সর্বোচ্চ নেতা!' ইরানে এখন যা হচ্ছে, তাতে অভিভূত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। নারীর অধিকার ভূলুণ্ঠিত থেকে সৃষ্ট ক্রোধে সেখানে যে মাত্রার বিক্ষোভ হচ্ছে, তা বিশ্বে বিরল। পুরুষরা আন্দোলনে অংশগ্রহণে রাস্তায় নেমে এসেছে। এর মাধ্যমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে আন্দোলন হয়, তার তুলনায় এ বিক্ষোভে অধিক বৈচিত্র্য স্পষ্ট। ইরানের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিপীড়নমূলক শাসনে মানুষের যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল, তাও এ আন্দোলনে স্পষ্ট।

তবে বাস্তবতার চেয়ে আমাদের প্রত্যাশাকে এগিয়ে রাখতে হবে। আমরা যে চিত্র দেখছি, তা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ চিত্রের চেয়ে ভিন্ন। একেবারে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনের গোড়া থেকে পাওয়া প্রতিবেদন খুবই সীমিত। এক দশক কিংবা তার বেশি সময়ে আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রযুক্তির অস্বাভাবিক প্রদর্শনী দেখছি। আমরা বারবার দেখেছি, একজন ব্যক্তির মোবাইল ফোন থেকে ছাড়া একটি ভিডিও ক্লিপ কীভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখ লাখবার শেয়ার হতে পারে। এর পর সেটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে আরও বড় করে প্রচার করা হয়। কোনো প্রাদেশিক শহরের একটি সড়কের চিত্র জনবহুল একটি দেশের অবস্থার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটায় না। এখন ইরানে জনবিক্ষোভ কতটা ব্যাপক, তা বলা কঠিন। সাংবাদিক, একাডেমিক বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি গোয়েন্দা বিশ্নেষকরা দেখবেন, চাক্ষুষ প্রমাণ অপর্যাপ্ত। আবেগপূর্ণ ছবির তুলনায় তাঁদের বিশ্নেষণের প্রভাব খুব কমই সাড়া ফেলে। জনপ্রিয় রাজনীতিবিদরা এটি জানেন। সন্ত্রাসীরাও জানে। কিন্তু আমরা সত্যকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি।

৪৩ বছর আগে রেজা শাহ পাহলভি শুধু খোমেনির ধর্মীয় গ্রুপের মাধ্যমেই ক্ষমতাচ্যুত হননি। বিরোধী শক্তিগুলোর একত্রিত হওয়ার ফলেই তাঁর পতন হয়। সেখানে বিচিত্র ধারার সমাবেশ ঘটেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ শহুরে প্রগতিশীল, পুরোনো ধারার সমাজতান্ত্রিক, নতুন বাম ফেদায়ি, ইসলামী-মার্ক্সিস্ট গেরিলা এবং ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সমর্থিত ক্যুতে পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের অনুসারী জাতীয়তাবাদীরাও ছিল। ১৯৭৮ ও '৭৯ সালের ইরানের সেই আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে অন্যতম পোল্যান্ডের সাংবাদিক জিয়ার্ড কাপুসিনস্কি, যিনি তেহরানের গণবিক্ষোভকে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন, 'একটি বিশাল এবং টগবগে মানব-নদী, যেটি মূল সড়ক ধরে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি প্রবাহিত হচ্ছে। একটি উন্মত্ত বন্যা এমন অবস্থায় রয়েছে যে, সব ডুবিয়ে ফেলবে।' সে সময় মানুষের ঢল এত বেশি ছিল যে, সিটি সেন্টার পার হতে তাদের ৮ ঘণ্টা লেগেছিল। এখন তেহরানে কোনো কাপুসিনস্কি নেই। এমনকি ৮ ঘণ্টার পদযাত্রাও নেই। রূঢ় বাস্তবতা হলো, যদিও এসব বিক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ; তারপরও শক্তিশালী ক্ষমতা তাদের খেয়ে ফেলতে পারে।

বিক্ষোভরত ছবি আন্দোলনের গভীরতার ব্যাপারে অনেক সময় আমাদের অতিরঞ্জিত ধারণাই দেয় না; একই সঙ্গে তাদের শত্রুদের শক্তিকেও অবমূল্যায়ন করা হয়। তবে ইরানে এখন যারা আন্দোলন করছে এবং বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করছে, তারা নিঃসন্দেহে শক্তিশালী।

স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেটের কারণে অনেক সময় বহু দূরের ঘটনা ব্যাখ্যা করার সমস্যা থাকে। ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের খবর বিশ্বব্যাপী হাজারো সাংবাদিক প্রচার করেছিলেন। তেহরানে ফেরার আগে কয়েক মাস খোমেনি যে প্যারিসে ছিলেন; সে সময় তিনি ১৫০টি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এমনকি জাঁদরেল অনেক সাংবাদিকও গণতন্ত্র, নারীর অধিকার এবং সহনশীলতা প্রসঙ্গে খোমেনির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সে সময় ইরানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত খোমেনিকে মাহাত্মা গান্ধীর মতো বলেছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে খোমেনি নির্দয়ভাবে তাঁর সব বিরোধীকে দমন করেন; অনেককে জেলে ভরেন এবং নারীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করেন।

আজকে সংবাদের সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু যেভাবে এটি আমাদের কাছে পৌঁছে এবং যেভাবে একে গ্রহণ করা হয় ও প্রযুক্তির মাধ্যমে সামনে আসে; সেখানে এক ধরনের ঝুঁকি আছে। তথ্যের পথকে অনেক সময় প্রবাহ হিসেবে তুলনা করা হয়। তার মানে, এটি অব্যাহত, স্থির, ছন্দময়। বাস্তবে এটি খুবই ঢেউ খেলানো। কোনো কিছু সংঘবদ্ধ দেখার মাধ্যমে অর্থ তৈরি হয় বটে; কিন্তু সেখানে অনেক গ্যাপ দেখা যায়। কেউ আবার কুসংস্কার ও ভয়কে কাজে লাগিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খোঁজে। কেউ আবার স্বপ্ন এবং আশার দিক থেকে অসম্পূর্ণ ছবিকে সম্পূর্ণ ভাবে।

এর মানে এটা নয়, যারা ইরানের রাস্তায় এখন বিক্ষোভ করছে, তাদের প্রশংসা করা হবে না। তাদের উদাহরণ উদযাপনযোগ্য। কিন্তু যখন আমরা চিন্তা করি, কীভাবে সহায়তা করব এবং সমর্থন করব, তখন আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত। বাস্তব চোখে স্পষ্ট দেখা থেকেই সেভাবে আচরণ করা উচিত। মিথ্যা আশাবাদী হয়ে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। তাহলেই আমাদের সমর্থন আরও মূল্যবান হবে।

জেসন বার্ক: ব্রিটিশ সাংবাদিক; গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক