গত ১১ নভেম্বর জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের (কপ২৭) ষষ্ঠ দিনকে ডিকার্বনাইজেশন দিবস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দিনে মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা হয়। বিদ্যুৎ, সড়ক পরিবহন, ইস্পাত শিল্প, হাইড্রোজেন জ্বালানি ও কৃষি- এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে আগামী ১২ মাসের মধ্যে অর্থাৎ কপ২৮-এর আগে ডিকার্বনাইজেশন বা কার্বনমুক্তকরণ প্রক্রিয়া গতিশীল করতে ২৫টি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একটি অ্যাকশন প্ল্যান করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে সস্তায় ও সহজলভ্যভাবে ক্লিন এনার্জি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে বলে বিশ্বনেতারা আশাবাদী। এই ক্লিন এনার্জির একমাত্র উপায় হলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি। সুবিধাজনক ভৌগোলিক অবস্থানের ফলে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত কপ২৬-এ ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে দেশের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন।

বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই খুবই নাজুক অবস্থানে রয়েছে। প্রতি বছর বায়ুদূষণের কারণে এখানে মৃত্যুহার যেমন বাড়ছে, তেমনি দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যান্য কারণের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অন্যতম। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবপোর্টালে দেওয়া তথ্যমতে, দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় মাত্র ৯৪৯ মেগাওয়াট আর ২৪ হাজার ৭৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে ফার্নেস তেল, ডিজেল, গ্যাস ও কয়লা পুড়িয়ে। অর্থাৎ দেশের সিংহভাগ বিদ্যুতের চাহিদা মেটানো হয় জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে। এর মধ্যে বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। 

বর্তমানে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে মাতারবাড়ী নামে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)- গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান- প্রকল্পটির কাজ করছে, যার আনুমানিক ব্যায় প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার এবং এটি ১ দশমিক ২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র; যা ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত এবং ২০১৩ সালের অক্টোবরে পরিবেশগত ছাড়পত্র পায়। প্রকল্পটির নির্মাণকাজ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়, যা ২০২৪ সালে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরিকল্পিত এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১০ শতাংশ অবদান রাখবে বলে সরকার আশাবাদী। আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, পরিচালিত ২০২০ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কপবাজারের মহেশখালী পাওয়ার হাবটিতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ৩০ বছর ধরে পরিচালিত হলে আনুমানিক ৩০ হাজার মানুষ বায়ুদূষণজনিত নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ মানুষ ও প্রাণীর স্বাস্থ্যের ওপর স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কেন্দ্র থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্ত হবে। এ ছাড়া আনুমানিক ১ কেজি ৬০০ গ্রাম পারদ অবমুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যার ৪০ শতাংশ মাটি-পানির সঙ্গে মিশে এলাকার স্বাদু পানির ইকোসিস্টেমে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বায়ুদূষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। তাই বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছে। পরিবেশ দূষণ রোধে সরকারের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা। ২০২২ সালের মে মাসে জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো কয়লাভিত্তিক নতুন প্রকল্পে তহবিল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চীন গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশকে জানিয়েছে, তারা অতিরিক্ত শ্রম ও শক্তি খরচ হয়, যেমন কয়লা খনন এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প গ্রহণ করতে আর ইচ্ছুক নয়। এ উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপানি ব্যাংক। পরিবেশবাদীরা এ সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলেও তাঁরা কয়লাভিত্তিক প্রকল্প পুরোপুরি বাতিলের দাবি করে আসছেন। 

জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও যানবাহন, বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কয়লাসহ তেল-গ্যাস ব্যবহারের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন বায়ুদূষণের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। এমনকি তেল-গ্যাস শিল্প প্রক্রিয়া থেকে বিশ্বব্যাপী ১০ শতাংশের বেশি কার্বন ডাই-অপাইড নির্গমন হচ্ছে। এ ছাড়া তেল-গ্যাস উত্তোলনের সময় মিথেন গ্যাস লিকেজ হয়। মিথেনও একটি গ্রিনহাউস গ্যাস, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী। তাই নবায়নযোগ্য বিকল্প জ্বালানির দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক মিথেন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমানোর উদ্দেশ্য সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিশ্বের ১২২টি দেশ বিশ্ব মিথেন চুক্তিতে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বনেতারা আজ একমত, বিশ্বস্ততা ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ দরকার। কমপক্ষে ৫০টি বড় আকারের প্রায় শূন্য কার্বন নির্গমন করে এমন শিল্পকারখানা এবং ১০০টি নবায়নযোগ্য হাইড্রোজেন শক্তির সোর্স গঠন করতে হবে। পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত পাওয়ার গ্রিড প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনজাত দূষণ রোধ করার জন্য একটি বাস্তবিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

সৌরবিদ্যুৎ আমাদের দেশে দূষণ কমানোর জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে এবং সেই প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক হিসেবে মোংলায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ সোলার পার্কের নির্মাণ প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকল্পটি দেশের টেকসই জ্বালানি অবকাঠামোকে বৈচিত্র্যময় করার সরকারের যে লক্ষ্য, তা অর্জনের দিকে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ এবং সেই সঙ্গে মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনার অন্যতম অংশ। যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৩০ শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ স্রেডার তথ্য অনুসারে, দেশে নয়টি সোলার পার্ক ইতোমধ্যে চালু রয়েছে এবং আরও ৩১টির পরিকল্পনা চলমান পর্যায়ে, যা বর্তমান সরকারের একটি সাফল্য বলে বিবেচনা করা যায়। বাংলাদেশে বায়ুদূষণ একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বায়ুদূষণ প্রতিনিয়ত মানুষের প্রাণ, সম্পদ ও অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। আইনের অভাব, অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নির্মাণ, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব ও পর্যবেক্ষণের অভাব এর জন্য দায়ী। তাই সরকারের উচিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা, তাহলে বাংলাদেশে জ্বালানি উৎপাদনের ফলে সৃষ্ট বায়ুদূষণ অনেকাংশে কমানো যাবে এবং একটি পরিবেশবান্ধব ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হবে।