- আন্তর্জাতিক
- রহস্যময় মহাকাশ গেমসে নাসা জয়
রহস্যময় মহাকাশ গেমসে নাসা জয়

'নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০২২' প্রতিযোগিতার মোস্ট ইন্সপিরেশনাল ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের 'টিম ডায়মন্ডস'
মহাকাশ গবেষণায় তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিবছর 'নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ' শীর্ষক প্রতিযোগিতা আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা)। বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশ ভার্চুয়ালি আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী দেশগুলো সেরা প্রতিযোগীদের বাছাই করতে স্থানীয়ভাবে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। নির্বাচিত সেরা দলগুলো এ প্রতিযোগিতার বৈশ্বিক আয়োজনে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। বাংলাদেশ তৃতীয়বারের মতো এ প্রতিযোগিতাটিতে অংশ নিয়েছে।
প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ পর্বের আয়োজক ছিল সফটওয়্যার খাতের সংগঠন বেসিস। বেসিস ও বেসিস স্টুডেন্টস ফোরামের সহযোগিতায় আয়োজিত নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের এবারের আসরে বাংলাদেশ পর্বে পাঁচ শতাধিক প্রকল্প জমা পড়ে। যাচাই-বাছাই শেষে ১২০টি প্রকল্পের প্রতিনিধিরা ৪৮ ঘণ্টাব্যাপী হ্যাকাথনে অংশ নেন এবং সেরা ১৮টি প্রকল্প নাসার জন্য বাংলাদেশ থেকে মনোনীত করা হয়। বাংলাদেশের ৯টি শহরে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কুমিল্লা বিভাগের হয়ে অংশগ্রহণকারী 'টিম ডায়মন্ডস' ছিল বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন দল। বাংলাদেশ থেকে 'টিম ডায়মন্ডস' দল ইন্সপিরেশনাল ক্যাটাগরিতে অংশ নেয় নাসার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায়। বিশ্বের ১৬২টি দেশের ৫ হাজার ৩২৭টি দলকে হারিয়ে মোস্ট ইন্সপিরেশনাল ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয় দলটি। সম্প্রতি নাসার ওয়েবসাইটে বিজয়ী দলের নাম প্রকাশিত হয়। মূলত এবারের প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের জন্য ৫ হাজার ৩০০টি দল বিশ্বের ১৬২টি দেশে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। নাসা এবং নাসার অংশীদার মহাকাশ সংস্থাগুলোর থেকে ওপেন সোর্স ডাটা ব্যবহার করে পৃথিবীর এবং মহাকাশের বাস্তব সমস্যার সমাধানে তরুণ গবেষক ও বিজ্ঞানীদের উৎসাহিত করতে এ প্রতিযোগিতাটি আয়োজিত হয়। সর্বমোট ১০টি ক্যাটাগরিতে এ প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়।
এগুলো হচ্ছে- বেস্ট ইউজ অব সায়েন্স, বেস্ট ইউজ অব ডাটা, আর্ট অ্যান্ড টেকনোলজি, বেস্ট ইউজ অব টেকনোলজি, গ্যালাক্টিক ইমপ্যাক্ট, বেস্ট মিশন কনসেপ্ট, মোস্ট ইন্সপিরেশনাল, বেস্ট স্টোরিটেলিং, গ্লোবাল কানেকশন এবং লোকাল ইমপ্যাক্ট। এর মধ্যে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মোস্ট ইন্সপিরেশনাল ক্যাটাগরিতে।
নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ-২০২২ বাংলাদেশ পর্বের আহ্বায়ক ও বেসিস পরিচালক তানভীর হোসেন খান বলেন, 'গত ১৭ নভেম্বর নাসা ৩৫টি গ্লোবাল ফাইনালিস্ট দলের একটি তালিকা প্রকাশ করে স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ ২০২২-এর মূল ওয়েবসাইট। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র দল হিসেবে ওই তালিকায় জায়গা করে নেয় 'টিম ডায়মন্ডস' এবং সব বিচার প্রক্রিয়া শেষে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে।
টিম ডায়মন্ডের নাসাজয়ী গেমস
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী মিলে তৈরি করেন 'টিম ডায়মন্ডস' দল। ডিআইইউ থেকে টিম ডায়মন্ডসের সদস্যরা হচ্ছেন টিসা খন্দকার (দলনেতা), মুনিম আহমেদ ( ইউএক্স ডিজাইনার), ইনজামামুল হক সনেট ( সিস্টেম আর্কিটেক্ট), আবু নিয়াজ ( অ্যান্ড্রয়েড ডেভেলপার)। এ ছাড়া টিম ডায়মন্ডসে গবেষক হিসেবে যুক্ত আছেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির জারিন চৌধুরী। দলটির মেন্টর হিসেবে ছিলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালেদ সোহেল।
প্রতিযোগিতাটি আয়োজনে বেসিসের সঙ্গে যুক্ত আছেন অধ্যাপক খালেদ আহমেদ সোহেল। মূলত তাঁরই আগ্রহে এ প্রতিযোগিতাটিতে অংশগ্রহণে শেষ দিনে নিবন্ধন করে 'টিম ডায়মন্ডস'।
দল গঠন সম্পর্কে টিসা খন্দকার বলেন, "ক্লাসে স্যার এ প্রতিযোগিতাটি সম্পর্কে বললে আমরা তিন বন্ধু (টিসা, মুনিম ও সনেট) আগ্রহ প্রকাশ করি। কিন্তু ওই দিনের আগে এ প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না। প্রতিযোগিতাটিতে অংশগ্রহণে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী জারিন চৌধুরী নিয়মিত এ সম্পর্কিত কর্মশালায় (বুট ক্যাম্প) অংশ নিত। ওই সব বুটক্যাম্প পরিচালনায় স্যারও (অধ্যাপক খালেদ সোহেল) থাকতেন। জারিন চৌধুরীর কোনো দল না থাকায় তাঁকে স্যার আমাদের টিমে দিয়ে দেন। তখন আমরা চারজন হই। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন ছিল একজন ডেভেলপার। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিযোগিতাটি সম্পর্কে জানিয়ে টিমের সদস্য হিসেবে একজন ডেভেলপারকে যুক্ত করা হবে বলে জানিয়ে পোস্ট দিই। এই পোস্ট দেখে আবু নিয়াজ আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এভাবেই তৈরি হয় 'টিম ডায়মন্ডস'। স্যারের তত্ত্বাবধানে আমরা গেমটি ডেভেলপে কাজ শুরু করি।"
তিনি বলেন, আমাদের প্রজেক্টের নাম 'ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই'। মহাকাশের রহস্য জানা ও বোঝার জন্য এটি ইন্টারেক্টিভ গেম। শিশুরা গেমটি খেলার মাধ্যমে সহজেই নক্ষত্রদের রং, উজ্জ্বলতা, ভর ও দূরত্বের পরিবর্তন সম্পর্কে জানতে পারবে। এর পেছনে লুকিয়ে থাকা কারণগুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। গেমটি খেলার মাধ্যমে শিশুরা তাদের নিজস্ব নক্ষত্র তৈরি থেকে শুরু করে নক্ষত্রগুলোর প্যাটার্ন, রঙের পরিবর্তন, উজ্জ্বলতা, ভরের পরিবর্তন অনুমান করতে পারবে। রাতের আকাশ বোঝার জন্য গেমটি সত্যিই চমৎকার।
গেমটি সম্পর্কে টিম ডায়মন্ডসের দলনেতা টিসা খন্দকার বলেন, টিম ডায়মন্ডস মূলত কাজ করেছে শিশুদের নিয়ে যাতে তারা ছোটবেলা থেকেই মহাকাশ নিয়ে ভাবতে পারে, মহাকাশের অজানা সব তথ্য সম্পর্কে খুব সহজে জানতে পারে। মহাকাশে থাকা অজস্র নক্ষত্র, এদের পরিবর্তন সাধারণত খালি চোখে দেখা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কারণ এই পরিবর্তনগুলো খুব ধীর বা চোখের জন্য খুব ক্ষীণ হয়। তাদের চ্যালেঞ্জের মূল বিষয়বস্তু ছিল নাক্ষত্রিক এই পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে মানুষকে শেখানো, তাদের বুঝতে সাহায্য করা যে রাতের আকাশ আসলে কতটা গতিশীল! পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, এটি সত্যিই অসাধারণ অনুভূতি।
আমরা চ্যাম্পিয়ন হবো, এটা সত্যিই ভাবিনি। এটা শুধু নিছক চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়, আমাদের স্বপ্নের বিজয়। প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ পর্বের আয়োজক বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, 'স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মিত হচ্ছে আমাদের তরুণদের হাত ধরে। তরুণদের নিয়ে গড়া ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দল টিম ডায়মন্ডস বিশ্বচ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেছে, যা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বড় অর্জন।'
বিজয়ীদের জন্য নাসা পরিদর্শনের সুযোগ
চূড়ান্ত পর্বেও বিজয়ী দলগুলো নাসা কেন্দ্র পরিদর্শনের সুযোগ পাবে। এ পরির্দশনের মাধ্যমে নাসার বিভিন্ন কার্যক্রম ও গবেষণা সম্পর্কে জানতে পারবেন বিজয়ীরা। পাশাপাশি নাসার একটি মহাকাশযান উৎক্ষেপণ দেখার সুযোগ পাবেন বিজয়ীরা।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
টিম ডায়মন্ডসের তিন বন্ধু টিসা, মুনিম ও সনেট হচ্ছেন ফাইনাল সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। সামনেই সমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষার ব্যস্ততার মাঝেই গেমটি পূর্ণাঙ্গ রূপে ডেভেলপে মনোযোগ দিচ্ছেন তাঁরা। তবে সমস্যা হচ্ছে, তাঁদের দলে ডেভেলপার মাত্র একজন। টিম ডায়মন্ডস আগামী বছরই শিশু-কিশোরদের উপযোগী এ গেমটির অ্যান্ড্রয়েড সংস্করণ গুগল প্লেস্টোরে দিতে চান। তবে সেটি নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি তাঁরা সেটি ডেভেলপ করতে পারবেন। টিসা খন্দকার আশা করছেন, আর্থিক সহায়তা পেলে তারা দ্রুতই গেমটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ আনতে সক্ষম হবেন। আর সেটি হলে গেমটির মাধ্যমে মহাকাশের রহস্য আরও ভালোভাবে জানা-বোঝার সুযোগ হবে আমাদের স্কুলপড়ূয়া খুদে শিক্ষার্থীদের।
মন্তব্য করুন