শহীদুল হক ভূঁঞা সরকারের অতিরিক্ত সচিব। বর্তমানে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান। রাজধানীর গুলশানের ঠিকানায় 'ইউরো মোটরস লিমিটেড' নামে কোম্পানি খুলে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাজেদুল হককে চেয়ারম্যান ও বোন ফারজানা হককে ভাইস চেয়ারম্যান করেছেন তিনি। অভিযোগ উঠেছে, নিজের প্রভাব খাটিয়ে শহীদুল হক প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউরো মোটরসকে অন্তর্ভুক্ত এবং গাড়িগুলো এখানেই বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বোন ও বন্ধুর নামে কোম্পানি হলেও শহীদুলই কলকাঠি নাড়েন। বিষয়টি অনেকটা যিনি ক্রেতা তিনিই ঠিকাদারের মতো। এতে গাড়ি সরবরাহের কমিশনটা আর বাইরে যাবে না। এর আগে ২০২১ সালের ১২ আগস্ট মাজেদুল হককে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের আইন উপদেষ্টা করেন শহীদুল। মূলত শহীদুল হক, জাহিদ হোসেন ও মাজেদুল হকের মধ্যে গাড়ি সরবরাহের লাভ ভাগাভাগির অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়া রয়েছে। সেটি কার্যকরে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের সব নিয়মকে তোয়াক্কা করেননি তাঁরা।

সরকারি কর্মচারী আচরণবিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা কোম্পানি করতে পারবেন না। আত্মীয়স্বজনকে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লাভজনক কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কেও যুক্ত করতে পারবেন না। অথচ বিএসইসিতে এসব নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন শহীদুল হক।

এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব (জনপ্রশাসন) ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া সমকালকে বলেন, 'আইন উপদেষ্টার মতো পদে থেকে মাজেদুল হকের কোনোভাবেই প্রগতির সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আইনে নেই।' তিনি আরও বলেন, ''নিয়ম অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তা যেখানে বা যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকেন, সেখানে তাঁর ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান কিংবা আত্মীয়স্বজনেরা আর্থিকভাবে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। কারণ তিনি তাঁদের সুবিধা দিতে প্রতিষ্ঠানে প্রভাব খাটাতে পারেন। এটি 'কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট' ও সরকারি চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।''

ইউরো মোটরস লিমিটেড গুলশানের ১৬/এ নম্বর রোডের ১০ নম্বর হোল্ডিংয়ের পঞ্চম তলায়। প্রতিষ্ঠানের মেমোরেন্ডামে দেখা গেছে, চেয়ারম্যান মাজেদুল হক, ঠিকানা উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ৮ নম্বর রোডের ৩০ নম্বর হোল্ডিং। ভাইস চেয়ারম্যান শহীদুল হকের আপন বোন ফারজানা হক (বাবা- মোহাম্মদ আজিজুল হক ভূঁঞা; মা- আনোয়ারা হক ভূঁঞা)। মেমোরেন্ডামে ফারজানা হকের যে মোবাইল ফোন নম্বর উল্লেখ রয়েছে, সেটি শহীদুল হক নিজে ব্যবহার করেন। কারণ হিসেবে প্রগতির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, কোম্পানিতে বোনের কেবল নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আসলে শহীদুল হক ভূঁঞাই সবকিছু।

ইউরো মোটরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে আছেন গুলশানের ৭১/৭৬ নম্বর রোডের ১/বি নম্বর রোডের ২৪ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন। এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, 'মাজেদুল হক আমার পূর্বপরিচিত। তিনিই আমাকে একদিন নতুন একটি কোম্পানি খুলে প্রগতির সঙ্গে ব্যবসার প্রস্তাব দেন। তখন মাজেদুল হক ও শহীদুল হক ভূঁঞা মিলে ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ফারজানা হকের নাম প্রস্তাব করেন এবং তাঁরা বলেন ফারজানা শিক্ষিত ভদ্রমহিলা। আমি তখন জানতাম না ফারজানা সম্পর্কে শহীদুল হকের আপন বোন। পরে দেখেছি তাঁদের দুজনের মা-বাবার নাম একই। এখন পর্যন্ত ফারজানা হকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। আর মাজেদুল হক প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের আইন উপদেষ্টা, সেটি আগেই জানি।'

মাজেদুল হকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করে বন্ধ পাওয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে তিনি বিদেশে অবস্থান করছেন। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ, এমন কি এসএমএস পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে শহীদুল হক ভূঁঞার দপ্তরে গেলে তিনি বিব্রতবোধ করেন এবং কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

গাড়ি আমদানিতে ইউরো মোটরসকে সুবিধা: প্রগতির বোর্ড সভার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ইউরো মোটরস লিমিটেড গত ১৬ জুন পাঁচ ধরনের (জিপ, মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স, স্কুলবাস ও কার্গো) গাড়ি প্রগতিকে সরবরাহের কোটেশন দিয়েছিল। গাড়িগুলো জার্মানি ও জাপান থেকে আমদানি করে তারা প্রগতিকে দেবে। কিন্তু ২২ জুন প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের ৩২৫তম বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ইউরো মোটরসের প্রস্তাবিত গাড়িগুলো ভারত থেকেও আমদানিযোগ্য। সভায় গাড়ির বৈচিত্র্য আনা ও আমদানি পর্যায়ে ডলার সাশ্রয়ে ভারতের ফোর্স মোটরসের গাড়িগুলো বাজারজাত করার পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে মত দেওয়া হয়। বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফোর্স মোটরসের গাড়ি ব্যবহার করে। ফোর্স মোটরসের গাড়ির ক্ষেত্রে দামও পুনঃনির্ধারণ হবে। বৈঠক থেকে ইউরো মোটরসকে নতুন করে ভারতীয় গাড়ির দর দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।

এ বিষয়ে ইউরো মোটরসের এমডি জাহিদ হোসেন বলেন, 'আমরা ভারতীয় গাড়ির জন্য নতুন দরপত্র দিয়েছি। কিন্তু এখনও সরবরাহের অনুমতি পাইনি।'