তাদের চোখে বাংলাদেশ কৃষির বাতিঘর

কোলাজ
জাহিদুর রহমান, শ্রীলঙ্কা থেকে
প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:০৪ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০০:৪৮
আলপাজ, শ্রীলঙ্কার তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা। কফি চাষে দেশটিতে বেশ শোরগোল ফেলেছেন। তাঁর বাগানের কফি যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকায়। কলম্বো শহরের হিলটন হোটেলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ৩৭তম এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলনের (এপিআরসি৩৭) দ্বিতীয় দিনে কথা হয় এই কৃষি উদ্যোক্তার সঙ্গে।
পুরোনো চা বাগানে কফি চাষ করে চমক দেখানো এই তরুণের চোখে-মুখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়। থমকে যাওয়া দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করার ভাবনা তাঁর কণ্ঠে। বললেন, এখানকার চা যেমন বিশ্বজয় করেছে, শ্রীলঙ্কার কফিও এক সময় নাড়িয়ে দেবে পৃথিবী। এর কারণ চা ও কফি একসঙ্গে মিশ্র ফসল হিসেবে চাষ করা হয়। এতে উৎপাদন খরচ কমছে। কফিতেই এখন কৃষি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করছেন। তাঁর আশা, চায়ের দেশ শ্রীলঙ্কা এক দিন কফির দেশ হিসেবে দ্যুতি ছড়াবে।
বাংলাদেশের নাম শুনে আরও আন্তরিক হয়ে ওঠেন আলপাজ। বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ কৃষির বাতিঘর। করোনা মহামারির ধাক্কা বাংলাদেশে এক কৃষিই ঠেকিয়ে দিয়েছে। বিশ্ব যখন ধুঁকছে, তখন বাংলাদেশে খাদ্য সংকট নেই। কারণ ওই দেশের কৃষক অনেক পরিশ্রমী। সরকারও আন্তরিক। বাংলাদেশের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। তাদের কৃষি অন্যদের জন্য উদাহরণ। কিছু সম্ভাবনা কাজে লাগালে এশিয়া অঞ্চলে কৃষিতে নেতৃত্ব দেবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে মিশ্র কফি বাগানের চাষ শুরু করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার ওয়ালসাপুগালা এলাকার কৃষক মাহিন্দা সামারাবিক্রেমা বলেন, শ্রীলঙ্কায় রাসায়নিক সারের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার পর আমাদের ধানের ফলন অর্ধেক কমে যায়। ৮ হেক্টর (২০ একর) জমিতে ধান এবং কলাবাগানের মালিক সামারাবিক্রেমা জানান, তাঁর এখন একটি খামার পরিচালনার মতো আয় নেই। বিশেষ করে কলার ফলনও কমে যাওয়ায় এ মৌসুমে আর ধান চাষ করছেন না তিনি।
২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা এক সময় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। তবে কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেশটিকে সম্পূর্ণরূপে জৈব কৃষি গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের অভিযান দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে। ফলে গত মার্চে শেষ হওয়া ভরা মৌসুম কৃষি উৎপাদনে লক্ষণীয় ধস দেখা যায়।
শ্রীলঙ্কার কৃষি বিভাগের প্রাক্তন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী লিওনেল ওয়েরাকুন বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার চেয়ে কৃষিতে এখন অনেকে এগিয়ে গেছে। সেখানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষকদের জন্য সরকারের ভর্তুকি এখন সব দেশের জন্য উদাহরণ। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার বিপুল অনাবাদি কৃষিজমিতে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারবেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা সার্কভুক্ত দেশ বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশ থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। সংকটে যে সহায়তা পাওয়া গেছে, শ্রীলঙ্কার জন্য তা ছিল স্বস্তিদায়ক। এ ধরনের আর্থিক সহযোগিতা শুধু স্বল্পমেয়াদি নয়, দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। যাতে বিনিয়োগের প্রবাহ তৈরি হয়ে সামগ্রিক উৎপাদন বাড়ে। কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। এতে অঞ্চলটির প্রতিটি অর্থনীতি যেমন টেকসই প্রবৃদ্ধির দিকে এগোবে, তেমনি বিশ্ব প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে হাজির হতে পারবে দক্ষিণ এশিয়া।
৩৭তম এশিয়া ও প্যাসিফিক আঞ্চলিক সম্মেলন (এপিআরসি৩৭) গত সোমবার থেকে শুরু হলেও গতকাল মঙ্গলবার সকালে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেন, সদস্য দেশগুলোর বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এফএওর সহযোগিতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিজমি হ্রাস ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ ছাড়া দুর্বল বিপণন ব্যবস্থা এবং রপ্তানি বিধিনিষেধের মতো বিষয়গুলো খাদ্য নিরাপত্তায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আগেরবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গবেষণার জন্য ‘বিশেষ তহবিল’ গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নে এফএওকে আহ্বান জানান মন্ত্রী। চার দিনের এফএওর চলমান আঞ্চলিক সম্মেলন শেষ হবে কাল বৃহস্পতিবার। সম্মেলনে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের ৪০টির বেশি দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি, এফএওর মহাপরিচালক, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী, এনজিও ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা অংশ নিচ্ছেন।
এদিকে গতকাল বিকেলে বাংলাদেশের কৃষিমন্ত্রী এফএওর মহাপরিচালক কিউ দোংয়ু এবং কমিটি অন ওয়ার্ল্ড ফুড সিকিউরিটির চেয়ারপারসন ও রোমে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত নসিফো নাউস্কা জ্যান জেজিলের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। এ সময় কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মাহমুদুর রহমান এবং এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি জিয়াওকুন শি উপস্থিত ছিলেন।