রণাঙ্গনে রুশ আধিপত্য

ছবি-সমকাল
ইলিয়াস হোসেন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৭:৫৯
রাশিয়া দুই বছর আগে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর অনেকে মনে করেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই দেশটি মস্কোর কবজায় চলে যাবে। তবে তা হয়নি। অভাবনীয় বীরবিক্রমে রাশিয়াকে রুখে দাঁড়িয়েছিল তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশী দেশটি। তখন মস্কোকে বিদ্রুপও শুনতে হয়েছে। এর পর কখনও রাশিয়া, আবার কখনও ইউক্রেন রণাঙ্গনে সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করে। ফলে স্মরণকালের মধ্যে ইউরোপের সবচেয়ে বড় এ যুদ্ধে কে জিততে যাচ্ছে, তা নিয়ে পূর্বাভাস দিতে হিমশিম খেয়েছেন সমর বিশেষজ্ঞরা।
সেই দোলাচল এখন দৃশ্যত দ্রুতই কেটে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা একমত, যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় এসে পরিস্থিতি এখন নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার অনুকূলে। এ যুদ্ধে ইউক্রেন জিততে পারে– এমন দাবি আর দেশটির নেতারাও করছেন না। তাদের কণ্ঠে বরং হতাশার সুরই বেশি বাজছে।
গত ৯ মাসের মধ্যে রাশিয়া প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের একটি বড় শহর দখল করে নিয়েছে। রুশ কর্মকর্তারা সোমবার ঘোষণা করেন, তাদের বাহিনী ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর আভদিভকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। গত বসন্তে বাখমুত দখলে নেওয়ার পর এটি রণাঙ্গনে দেশটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য। রুশ সৈন্যরা এখন মারিংকা, রোবোটাইন ও ক্রেমিনা দখলের দিকে নজর দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পূর্ণ মাত্রায় আগ্রাসনের দুই বছরের মধ্যে পরিস্থিতি কিয়েভের জন্য আর কখনও এতটা বিপজ্জনক বলে মনে হয়নি। মূলত মিত্রদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ পেতে ব্যর্থ হওয়ায় ইউক্রেন এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে।
সিআইএর সাবেক পরিচালক এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, আভদিভকা দখল করার মাধ্যমে রুশ সামরিক বাহিনী ইউক্রেন যুদ্ধের অচলাবস্থা ভেঙে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘রুশরা গতি ফিরে পেয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি রুশ সেনারা ৬০০ মাইল বিস্তৃত রণাঙ্গনে আক্রমণাত্মক অবস্থানে রয়েছে।’
বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অঞ্চল দখল করে আছে রাশিয়া। দেশটি দেখিয়েছে, তারা লাখ লাখ পুরুষকে ইচ্ছামতো যুদ্ধ করার জন্য জড়ো করতে পারে। এটা ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আরেকটি সুবিধা। অন্যদিকে, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর এখন আরও ৫ লাখ সেনা দরকার। তবে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সতর্ক করে বলেছেন, এটি একটি ‘সংবেদনশীল’ সমস্যা।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন হচ্ছে, ইউক্রেনের সামরিক ঘাটতি মার্চের শেষের দিকে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। দেশটি গোলাবারুদ এবং বিমান প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। এটা কার্যকরভাবে যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং পুতিনকে উল্লেখযোগ্য সুবিধা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতোই অভিন্ন মত পোষণ করতে শুরু করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা। মাত্র ১০ শতাংশ ইউরোপীয় নাগরিক বিশ্বাস করেন, ইউক্রেন এখনও রাশিয়াকে পরাজিত করতে পারে। রাশিয়া জিততে পারে– সেই ধারণা করছে এর চেয়ে বেশি মানুষ। জানুয়ারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১২টি দেশে অনলাইন সমীক্ষায় ১৭ হাজার ২৩ জন উত্তরদাতার প্রতিক্রিয়ায় এমন মনোভাব উঠে এসেছে।
গত বছর একই সময়ে ইউরোপীয়রা বলেছিল, ইউক্রেন তার সব হারানো অঞ্চল ফিরে পেতে পারে। বেশির ভাগ ইউরোপীয় এখন আর বিশ্বাস করে না, কিয়েভ সামরিক দিক থেকে জয়লাভ করতে পারে। ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, স্পেন, সুইডেনসহ ইইউর ১২টি সদস্য দেশের ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
গত সপ্তাহে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রি কুলেবাও হতাশার কথাই শুনিয়েছেন। সম্মেলনে নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘ইউরোপে শান্তির যুগ শেষ হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনীয় সৈন্যরা গোলাবারুদের অভাবে নিজেদের একটি শহর থেকে যখন পিছু হটে, তখন তাকে কেবল গণতন্ত্র এবং বিশ্বভিত্তিক ব্যবস্থা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা উচিত নয়। বরং চিন্তা করুন, রুশ সৈন্যরা আপনার শহরগুলোর কয়েক কিলোমিটার কাছে চলে এসেছে।’
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই আজ শনিবার এ যুদ্ধের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া।
ইউক্রেন অস্ত্র সংকটে ভুগলেও রাশিয়ার পাশে দাঁড়াচ্ছে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো মিত্ররা। এরই মধ্যে জানা গেছে, রাশিয়াকে ৪০০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র পাঠিয়েছে ইরান। এসব ক্ষেপণাস্ত্র ১৮৬ থেকে ৪৩৫ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম।
রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র দুই বছর চেষ্টা চালালেও তাতে তেমন সাফল্য আসেনি। এদিকে যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিও এখন মজবুত। গত বছর শুধু ভারতের কাছেই ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের তেল বিক্রি করেছে রাশিয়া। চীন, ভারত এবং ব্রাজিল রাশিয়ার কোষাগার পূরণ করছে।
ইউক্রেনের ভরসা যুক্তরাষ্ট্র
মূলত যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভর করেই ইউক্রেন এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে এসেছে। ওয়াশিংটন থেকে নগদ এবং অস্ত্র সহায়তা বাবদ ৭৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পেয়েছে কিয়েভ। এর বেশির ভাগই খরচ হয়ে গেছে। আরও ৬০ বিলিয়ন সহায়তা প্যাকেজ পাস হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য মিত্র দেশ এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে ১৭৮ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
রাশিয়াকে পর্যুদস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র মস্কোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বন্যা বইয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ দ্বিতীয় যুদ্ধবার্ষিকীর আগে রাশিয়া-সংযুক্ত ৫০০টি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বাইডেন প্রশাসন। শুক্রবার হোয়াইট হাউস ঘোষিত এ নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড় একক শাস্তি।
রাশিয়ার ক্ষতি
যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে রাশিয়া এ যুদ্ধে ২১১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এ সময় অস্ত্র বিক্রি কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলারের। যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার রুশ যোদ্ধা নিহত বা আহত হয়েছেন।
ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির গত ৮ ডিসেম্বরের একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, যুদ্ধ শুরুর আগে রাশিয়ার কাছে ৩ হাজার ৫০০টি ট্যাঙ্ক ছিল। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ২০০টি ধ্বংস হয়েছে। প্রতিবেদনটি মার্কিন কংগ্রেসে সরবরাহ করা হয়েছে।
ইউক্রেন কেন হারছে
যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম পলিটিকোর প্রতিবেদনে মোটাদাগে তিনটি কারণকে দায়ী করা হয়েছে ইউক্রেনের এই দুরবস্থার জন্য। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, মার্কিন রিপাবলিকানরা ইউক্রেনের সাহায্য আটকে দিয়েছেন। ইউরোপের ডানপন্থিরা কিয়েভকে পরিত্যাগ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা নেতারাও ইউক্রেনকে সহায়তার ক্ষেত্রে অতি-সতর্ক।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার সম্ভাবনা নিয়ে ভীষণ চিন্তিত ইউক্রেন। তিনি ২০২৩ সালে স্পষ্টই ঘোষণা দিয়েছিলেন, আবার নির্বাচিত হলে তিনি ‘এই যুদ্ধ এক দিন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে’ নিষ্পত্তি করবেন।
পলিটিকো বলছে, প্রেসিডেন্ট পুতিন অবশ্যই এই মুহূর্তটি উপভোগ করছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী আলেক্সি নাভালনির মৃত্যুর খবর নিয়ে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনকে বিদ্রুপ করেই ক্ষান্ত হননি। গোলাবারুদের তীব্র সংকটে ধুঁকতে থাকা ইউক্রেনীয় সৈন্যদের কাছ থেকে আভদিভকা শহর দখল করেও তিনি পশ্চিমা নেতাদের ঘুমে বিঘ্ন ঘটিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পশ্চিমের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের গতিপথ রাশিয়ার পক্ষে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পুতিন ২০২৪ সালকে ‘বড় সুযোগ’ হিসেবে দেখেছেন।
পলিটিকো বলছে, পশ্চিমারা ইউক্রেন যুদ্ধে হেরে যাবে, তা বলা হয়তো এখনই সমীচীন নয়। তবে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এটি হতে পারে। পশ্চিমারা ইউক্রেনকে ছেড়ে যায়নি। তবে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার দিকে বেশি ফোকাস করেছে। ফলে এই যুদ্ধ শেষ করার এবং পুতিনের সঙ্গে একটি চুক্তি করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে তারা। যত দ্রুত সম্ভব এটা চাইবে পশ্চিমারা। তবে তা বিপর্যয়কে ঠেকাবে নাকি আরও খারাপ কিছুকে আমন্ত্রণ জানাবে, তা নিশ্চিত নয় তারা।
সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বলেছে, তারা এমন কোনো লক্ষণ দেখতে পায়নি, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ক্ষয়ক্ষতির ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইনস্টিটিউট লিখেছে, ইউক্রেনের ওপর বর্তমান হারে রাশিয়া আরও অন্তত দু-তিন বছর এবং সম্ভবত এর চেয়েও বেশি সময় ধরে হামলা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে।