আল ইমরান। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার জেপিএলে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি গবেষণা করবেন মঙ্গলে প্রাণের বসবাসযোগ্য পরিবেশ অনুসন্ধানে। স্বপ্নবাজ এই তরুণের নাসাযাত্রার কথা শুনেছেন আশিক মুস্তাফা

নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরি বা জেপিএলে গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন নরসিংদীর ইমরান। তাঁর গবেষণার বিষয়- মঙ্গলগ্রহে প্রাণের বসবাসযোগ্য পরিবেশ অনুসন্ধান। মূলত তিনি মঙ্গলে প্রাণের উপস্থিতি ছিল কিনা কিংবা তাতে অর্গানিক ম্যাটেরিয়াল কী আছে- এসব নিয়ে গবেষণা করবেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে হোয়াটসঅ্যাপে নিজের এই অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে আল ইমরান কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পেছনে ফিরে যান। বলেন, 'আমি জীবনে বারবার হেরেছি। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগেও বারবার এখানের বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছি। বারবার নেতিবাচক মেইল পেয়েছি। তবু আমি হাল ছাড়িনি। চেষ্টা করে গেছি। সেই চেষ্টার ফসলই হচ্ছে এই অর্জন। যদিও আমি এখানে থামতে চাই না!'

বেড়ে ওঠা ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র
আল ইমরানের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার পশ্চিম রামপুরে। গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। এইটুকুন বয়স থেকেই নদের উৎস খুঁজে বেড়ানো ইমরান এখন মহাকাশে খুঁজবেন প্রাণের উৎস! ইমরানের বাবা নুরুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, মা মাহমুদা খাতুন গৃহিণী। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে ইমরান তৃতীয়। ভাইয়েরা চাকরি করলেও বোন করছেন শিক্ষকতা। ছোটবেলা থেকেই ইমরানের নতুন কিছু জানার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। হাতের কাছে যা পেতেন তাই নিয়ে চালাতেন বিস্তর গবেষণা। ইমরান তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন পশ্চিম রামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন এল কে ইউনিয়ন বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণি শেষ করে ভর্তি হন খিদিরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। নেন বিজ্ঞান বিভাগ। ২০০৪ সালে ওই স্কুল থেকে ৩.৫৭ পেয়ে পাস করেন এসএসসি। এরপর ভর্তি হন খিদিরপুর কলেজে।

সেখান থেকে ২০০৬ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ৪.৪০ পেয়ে পাস করেন এইচএসসি। অন্য আট-দশজন বাবা-মার মতো ইমরানের বাবা-মায়েরও ইচ্ছা ছিল- ছেলেকে পড়াবেন মেডিকেল কিংবা বুয়েটে। কিন্তু রেজাল্ট এ দুটির একটির পথেও এগোতে দেয়নি তাঁকে। তবে ইমরান তাঁর লক্ষ্যে ছুটেছেন। ভর্তি পরীক্ষা দিতে থাকেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিকেও যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু প্রথম বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না টিকলেও স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি। তাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস না করে ভর্তি প্রস্তুতি নিতে থাকেন। দ্বিতীয়বার ঠিকই টিকে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হন ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে। যে ছেলে অনেক কষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তিনি কিনা কঠোর পরিশ্রমে অনার্স ও মাস্টার্স উভয় পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বসেন! অনার্সে তাঁর সিজিপিএ ৩.৬৯ ও মাস্টার্সে ৩.৯৭।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার সময় মহাকাশ নিয়ে গবেষণার আগ্রহ জন্মে ইমরানের। এই আগ্রহই তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির গবেষক বানিয়েছে। যদিও অনার্স-মাস্টার্স শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ইমরানের। এ জন্য তিনি একাধিকবার আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি নিয়োগের জন্য বিবেচিত হননি। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে প্রায় এক বছর শিক্ষকতা করেন। ২০১৭ সালে ইমরান উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে আলাবামা আবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লানেটারি জিওসায়েন্সে মাস্টার্স করেন। অর্জন করেন পূর্ণ সিজিপিএ ৪। এরপর ২০২২ সালে ইমরান ইউনিভার্সিটি অব আরকানসায় স্পেস অ্যান্ড প্লানেটারি সায়েন্সে পিএইচডি করেন।

জেপিএলে ইমরানের কাজ
পিএইচডির শেষ দিকে জেপিএলে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোর বিজ্ঞপ্তি দেখেন ইমরান। করেন আবেদন। বিভিন্ন যাচাই-বাছাই, পরীক্ষা, সাক্ষাৎকার শেষে জেপিএলে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। গত ৩ জানুয়ারি জেপিএলে যোগ দেন আল ইমরান। জেপিএলের ওয়েবসাইটেও পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোর তালিকায় যুক্ত হয়েছে আল ইমরানের নাম। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনায় জেপিএলের অবস্থান। নাসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মর্যাদাসম্পন্ন গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর একটি জেপিএল। নাসার জন্য মনুষ্যবিহীন নভোযান তৈরি, পরিচালনা ও গবেষণার কাজ করে জেপিএল। ইমরান মঙ্গল গ্রহে প্রাণের বসবাসযোগ্য পরিবেশ নিয়ে কাজ করবেন জেপিএলে। একজন স্বপ্নবাজ তরুণ ইমরান। তাঁর মতো এমন স্বপ্ন তো আমরাও দেখতে পারি।