ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে সাত বছরের এক শিশুকে বের করে এনেছেন উদ্ধারকর্মীরা। তার সারা গায়ে ধুলা। চুল উশকোখুশকো। রাতে সে পরিপাটি হয়েই মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়েছিল। ব্যথায় যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন সে ভবনের ধ্বংসস্তূপে। এ যেন এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন! উদ্ধারের পর বারবার সে জিজ্ঞেস করছে, 'আমার মা কোথায়?' প্রশ্নটির উত্তর জানা নেই উদ্ধারকর্মীদের। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও তাঁদের নেই। তার প্রশ্নে উদ্ধারকর্মী অনেকে চোখের জল মোছেন।

গতকাল মঙ্গলবার তুরস্কের হাতায় শহরে উদ্ধার হওয়া ছোট্ট এই শিশুর মতো শত শত মানুষ জানেন না, তাঁদের আপনজন আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি মৃত! পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে অনেকে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেকে ভবনের ধ্বংসস্তূপের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছেন। অপেক্ষায় আছেন যদি কোনো স্বজনকে জীবিত পাওয়া যায়! সীমান্তের ওপারে সিরিয়ায়ও চলছে উদ্ধারকাজ। যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, ততই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। মৃতের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। কেবল তুরস্কেই মারা গেছেন ৫ হাজার ৪৩৪ জন। ১ হাজার ৮৩২ জনের প্রাণ গেছে সিরিয়ায়। দুই দেশে আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, মৃতের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়তে পারে। দুই দেশে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সোমবার ভোরে ভূমিকম্পে আকাশচুম্বী অনেক ভবনও ধুলায় মিশে গেছে। কোনো কোনো স্থানে বিপুল ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধার অভিযান চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ১০ শহরে তিন মাসের জরুরি অবস্থা জারি করেছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। তিনি জানান, বিশ্বের ৭০টি দেশের সরকারের পক্ষ থেকে তাঁর দেশের দুর্গতদের সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তিনি এসব দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে ধন্যবাদ জানান। মঙ্গলবার এরদোয়ান বিভিন্ন শহরের হোটেলগুলোকে ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা জানান।

অনেক পরিবারই ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। তাদের উদ্ধারে জোর তৎপরতা চালানো হলেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরূপ আবহাওয়া। তুষারপাত ও বৃষ্টিতে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার অভিযান। স্বজনহারা গৃহহীন বহু মানুষ রাস্তায় অবস্থান করছেন। বৈরী আবহাওয়ায় তাঁরা চরম দুর্ভোগে রয়েছেন।

এরই মধ্যে ভূমিকম্পের অনেক হৃদয়বিদারক ছবি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। একটি ছবিতে দেখা যায়, তুরস্কের কাহরামানমারাস শহরে বিধ্বস্ত ভবনের ইটপাথরের নিচে চাপা পড়া মৃত ১৫ বছরের মেয়ের হাত ধরে বসে আছেন বাবা হাসুত হেনসার। প্রচণ্ড ঠান্ডায় তিনি যেন জমে যাচ্ছেন। কিন্তু মেয়ের হাত ছাড়ছেন না। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ভূমিকম্পের ৩৩ ঘণ্টা পর গতকাল চার বছরের এক শিশুকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

বিবিসির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক এক সংবাদদাতা তুরস্কের উসমানিয়া শহর থেকে মঙ্গলবার উদ্ধার তৎপরতার বর্ণনা দিয়েছেন। শহরটি ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের কাছেই। তিনি জানান, বৃষ্টির কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। রাতে শহরটিতে বিদ্যুৎ ছিল না।

তুরস্কের প্রতিবেশী সিরিয়ার ভূমিকম্প ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরাঞ্চলের অবস্থাও করুণ। সেখানে উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে খালি হাতে। ওই অঞ্চলের কিছু অংশ সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণ করছে অনেক এলাকা। এসব এলাকায় আন্তর্জাতিক সহায়তা পৌঁছায়নি।

ভবনের ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার হচ্ছে। সিরিয়ায় কোথাও কোথাও ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া লোকজন সাহায্যের জন্য ডাকাডাকি করছেন। কিন্তু তাঁদের ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন কেউ নেই। এদিকে, তীব্র শীতের মধ্যে দুর্গতরা খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। তাঁরা বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যে দিনরাত পার করছেন। উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ত্রাণ সংস্থা হোয়াইট হেলমেটস ইমার্জেন্সি রেসপন্স গ্রুপ বলছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের বাঁচানোর সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

তুরস্কে দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আফাড জানিয়েছে, ২৪ হাজার ৪০০ জনের বেশি কর্মী অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের শঙ্কা, তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে উদ্ধারকাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশ উদ্ধারকাজে তুরস্ককে সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ভারত, জাপান, ইরাক, ইরান, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইসরায়েল, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে সাহায্য পাঠানো হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, সহায়তাকারী দল তুরস্কে উদ্ধারকাজ শুরু করতে সেখানে জড়ো হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে ফোনালাপে তিনি বলেন, তাঁর দেশ দুর্গতদের জন্য সব ধরনের সহায়তা পাঠাবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিশনার জেনেজ ল্যানারকিক মঙ্গলবার জানান, তাঁরা ১৯টি দেশের ১ হাজার ১৫০ জন প্রতিনিধি ও ৭০টি কুকুর নিয়ে ২৭টি অনুসন্ধান ও উদ্ধারকারী দল তুরস্কে পাঠিয়েছেন। চীন জানিয়েছে, তাদের একটি দল এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। সেইসঙ্গে দুর্গতদের জন্য ৫৯ লাখ ডলার জরুরি সহায়তা ঘোষণা করেছে।

যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি জানান, তাঁরা কুকুর, যন্ত্রপাতিসহ ৭৬টি উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছেন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের সামরিক বাহিনীর ৩০০ সদস্য সিরিয়ায় উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন। ভারত তুরস্কে দুটি উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) তথ্য অনুযায়ী, সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে রেকর্ড করা হয় ৭ দশমিক ৮। এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৭ দশমিক ৯ কিলোমিটার গভীরে তুরস্কের গাজিয়ান্তেপ শহরের নিচে। ভূমিকম্পের পর আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে তুরস্ক-সিরিয়ার মানুষ। ইউএসজিএস জানিয়েছে, মূল আঘাতের পর ১০০টির বেশি আফটারশক বা পরাঘাত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে তুরস্কের হাতায়, উসমানিয়া, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির ও কিলিস শহরে। সিরিয়ায় আলেপ্পো, লাটাকিয়া, হামা ও তারতুস অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।


বিষয় : আর্তনাদে ভারি বাতাস

মন্তব্য করুন