মাটির প্রায় ২৯ ফুট গভীরে ধনীদের কেনাকাটার অভিজাত কেন্দ্র, বিশ্বের প্রথম আলোকিত রাস্তা কিংবা প্রাচীন পাথরের মসজিদ, মোজাইকের সিনাগগ ও গুহায় নির্মিত গির্জা- কত কিছুই না ছিল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাতায় প্রদেশের রাজধানী আন্তাকায়ায়। হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শন বহন করা অঞ্চলটি এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ। গত সোমবারের ভয়াবহ ভূমিকম্প শহরটিকে মিশিয়ে দিয়েছে মাটির সঙ্গে। প্রাচীন সভ্যতার সব নিদর্শন নিশ্চিহ্ন। বাসিন্দারা বলছেন, এতদিন যে আন্তাকায়া তাঁরা দেখেছেন, সেটি আর অবশিষ্ট নেই। অনেকের আক্ষেপ, অচেনা ওই শহরে আর থাকার ইচ্ছা নেই তাঁদের। কারণ, এখানে আর কিছুই নেই। খবর নিউইয়র্ক টাইমসের।

৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রতিষ্ঠিত আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের এক জেনারেল বেশ কয়েকবার ধ্বংস করেছিলেন আন্তাকায়া। পরে তা আবার পুনর্নির্মিত হয়। গ্রিক, রোমান ও বাইজেন্টাইনরা এটিকে অ্যান্টিওক নামে ডাকতেন। শহরটি বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। একসময় রোমান সাম্রাজ্যের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ছিল আন্তাকায়া।

প্রাচীন এই শহর পরে আধুনিক রূপ পায়। যেখানে ভিড় করতেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য পর্যটক ও ভ্রমণপ্রেমী। কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের শহরটির বাসিন্দারা এই প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগের পর এখন আর কোনো কিছুতেই সান্ত্বনা পাচ্ছেন না। একদিকে স্বজন হারানো, অন্যদিকে ঘরবাড়িসহ কিছুই নেই। আর কিছুক্ষণ পরপর উদ্ধারকর্মীদের কাছ থেকে সংবাদ আসছে ধ্বংস্তূপ থেকে মৃতদেহ পাওয়ার। সব মিলিয়ে এমন অবর্ণনীয় দুঃসহ পরিস্থিতি তুরস্কের ওই অঞ্চলজুড়ে।

ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের বাঁচার আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে দিন দিন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার চার দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার থেকেই ধ্বংসস্তূপ থেকে আর বাঁচার আকুতি কানে আসছে না। হয়তো অনেকেই আর বেঁচে নেই।

মাটিতে মিশে যাওয়া স্থানীয় সুরম্য হোটেল স্যাভনের মালিক কাজিম কুসেরি জানান, আর আন্তাকায়ায় থাকতে চান না তিনি। বন্ধু ও স্মৃতিময় ভবনগুলো হারিয়ে গেছে। এ কারণে তিনি আর হাতায় প্রদেশে থাকার কোনো কারণ দেখেন না। কুসেরি অন্তত ২৫ জন আত্মীয় ও কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর হোটেলের পাশে একটি গাড়িতে এখন দিনযাপন করছেন।

এই দুর্যোগ থেকে কেউ রেহাই পায়নি। আন্তাকায়া শহরের প্রাচীনতম অংশে ছিল মসজিদ, গির্জা, চ্যাপেল ও সিনাগগ। সেসবও রক্ষা পায়নি। বহুকাল ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নাজির ছিল শহরটি। যদিও বিগত শতাব্দীর কয়েক দশক ধরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। ফলে বেশিরভাগ ইহুদি অনেক আগেই এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

তুর্কি কুর্দি যুবক আহমেত গুনেস বলেন, বিশ্বের প্রথম আলোকিত রাস্তাটি এভাবে দেখে তাঁর খুব খারাপ লাগছে। এটি খুব সুন্দর জায়গা ছিল। তিনি জানান, প্রায়ই নিজ শহর সানলিউরফা থেকে আন্তাকায়ায় গবাদি পশু বিক্রির জন্য আসতেন।

এই দুর্যোগের পর অধিকাংশ স্থানীয় বাসিন্দা শহর ছেড়ে চলে যাবেন বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন ইসা সোলমাজ নামে পঞ্চাশোর্ধ এক স্থানীয়। তিনি তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে এখন কাজ করলেও বড় হয়েছেন আন্তাকায়ায়। তিনি বলেন, আপনি ঘুম থেকে উঠে যখন এমন শহর দেখবেন, তখন আপনি আপনার শৈশবে দেখা স্মৃতিকে মনে করতে পারবেন না। এই ভূমিকম্পে ইতিহাস ও সভ্যতা শেষ হয়ে গেছে।