- আন্তর্জাতিক
- নওগাঁ থেকে অ্যামাজনে
অ্যামাজনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিন আহমেদ সুজা
নওগাঁ থেকে অ্যামাজনে

সালাউদ্দিন আহমেদ সুজা। গত ৫ ডিসেম্বর অ্যামাজনের লন্ডন অফিসে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এর আগে তিনি কাজ করেছেন ইন্দোনেশিয়ার গোজাক, জার্মানির ডেলিভারি হিরোসহ বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানে। ২০১৫ সালে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পাবিপ্রবি) থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে স্নাতক করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কোডিংয়ের সঙ্গে পরিচয় তাঁর। ল্যাবে প্রতিনিয়ত কোডিং করতেন। ইউভ, লাইটওয়াচ, কোটসেফ, হ্যাকার র্যাংকে হওয়া অনলাইন কনটেস্টগুলোতে অংশ নিতেন। দেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিত্ব করতেন। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম এক প্রতিযোগিতায় একবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন। ঢাকায় আইসিপিসিতে ২৫তম হয়েছিলেন। রাজশাহী পর্বে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে। পড়াশোনা শেষে দেশের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে জুনিয়র অ্যাপ ডেভেলপার হিসেবে যোগ দেন সুজা। বছরখানেক পর সেখান থেকে চাকরি নেন সহজ ডটকমে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন সহজে। এরপর পাড়ি জমান ইন্দোনেশিয়ায়।
ইন্দোনেশিয়া হয়ে বার্লিনে
২০১৯ সালে ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি দিয়ে প্রডাক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেশটির গোজাকে জয়েন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে সুজাকে লাইভ কোডিং টেস্ট ছাড়াও পাঁচটি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ায় চার বছর কাটিয়ে ২০২২ সালে পাড়ি জমান জার্মানির বার্লিনে। কাজ নেন ডেলিভারি হিরোতে। এই ডেলিভারি হিরো হলো আমাদের আলোচিত ফুডপান্ডার মাদার প্রতিষ্ঠান। ফুডপান্ডার মতো বেশ কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ডেলিভারি হিরো। এই মাদার প্রতিষ্ঠানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করেন সালাউদ্দিন আহমেদ সুজা। সেখানে তিনি মাইক্রো সার্ভিস, সিস্টেম ডিজাইন, অনকল প্রডাকশন সাপোর্টসহ প্রতিষ্ঠানের সিস্টেম রানিং রাখায় কাজ করতেন। ভালোই কাজ করছিলেন। তবে তাঁর স্বপ্ন যে অনেক বড়। সেই স্বপ্নের পথে যে ছুটতে হবে তাঁকে!
বার্লিন থেকে স্বপ্নের অ্যামাজনে
সুজাকে অবাক করে দিয়ে স্বপ্ন এসে যেন ধরা দিয়েছে তাঁর হাতে। কেমন করে? ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের কথা। বার্লিনের ডেলিভারি হিরোতে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। হঠাৎ অ্যামাজন থেকে লিংকডইনে মেসেজ পান সুজা। প্রতিষ্ঠানটি সুজাকে অবাক করে দিয়ে বলে, আপনি যদি অ্যামাজনে কাজ করতে আগ্রহী হন, তবে আমরা আপনাকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকতে চাই। এমন প্রতিষ্ঠান থেকে কাজের সুযোগ আসবে এভাবে, তা ভাবতেও পারেননি সুজা। তারা আবার সেই প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন কিনা অনুমতি চাচ্ছে! সব স্বপ্নের মতো লাগছিল সুজার কাছে। সুজার সম্মতি পেয়ে কিছুদিনের মাথায় লিংকডইনে তাঁকে আবেদনের লিংক পাঠায় অ্যামাজন। আবেদন করেন স্বপ্নবাজ সুজা। সপ্তাহ তিনেক পর অনলাইন জাজমেন্টে তাঁকে কোডিং টেস্ট পাঠানো হয়। দেওয়া হয় দুটি সমস্যা। ভালোভাবেই দুটির সমাধান করেন সুজা। এরপর লিডারশিপ পরীক্ষা; যেখানে একটি টিমে কীভাবে কাজ করা হয়, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কীভাবে কাজ করতে হয়, টেকনিক্যাল সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয়- বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে। সেটিও উতরে যান। তিন সপ্তাহ পর লাইভ কোডিংয়ের জন্য সুজাকে ইনভাইটেশন পাঠায় অ্যামাজন।
স্বপ্ন দিল ধরা
প্রথমে ছোট পরিসরে প্রবলেম দেওয়া হয়। সেই প্রবলেম সলভ করতে থাকলে ধীরে ধীরে ইনপুট লেভেলগুলো চেঞ্জ করতে থাকে কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে আসে কোডিং। লাইভ কোডিংয়ে সুজার পারফরম্যান্সে সন্তুষ্ট হয় অ্যামাজন কর্তৃপক্ষ। তারপর সুজাকে অনসাইড ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকা হয়। দু'দিনে ছয় ধাপের ইন্টারভিউ দেন সুজা। তিন সপ্তাহ পর অ্যামাজন থেকে ফোন পান সুজা। কর্তৃপক্ষ ফোনে বলে, 'আমরা তোমাকে সিলেক্ট করেছি। তোমার কোনো চাওয়া আছে?' সুজা বলেন, তোমরা অফার করলে ভেবে দেখব। দু'দিন পর অ্যামাজন সুজাকে অফার লেটার পাঠায়। ৫ ডিসেম্বর অ্যামাজনের লন্ডন অফিসে যোগ দেন সুজা। অ্যামাজনে চাকরি পেয়ে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভোলেননি তিনি। বলেন, 'আমি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
পাবিপ্রবির শিক্ষার্থী হিসেবে অ্যামাজনে যোগ দিতে পেরে নিজের মধ্যে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। পাবিপ্রবি থেকেও যে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাওয়া সম্ভব, তা এখন প্রমাণিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। এটা নেই-সেটা নেই! আমিও তা মানি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছু নেই। কিন্তু এই না থাকার মধ্যেও আবার অনেক কিছু আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা বিশ্বের ভালো ভালো জায়গায় কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। আমি বিশ্বাস করি, চেষ্টা করলে সবই সম্ভব। আমরা চেষ্টা করেছি। আমাদের পরবর্তী যাঁরা আছেন, তাঁরাও চেষ্টা করে ভালো জায়গাতে নিজেদের নিয়ে যাবেন। এতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন সুনাম হবে, তেমনি দেশের জন্যও কিছু করতে পারব আমরা।'
যত ব্যস্ততা
সালাউদ্দিন আহমেদ সুজা অ্যামাজনের ক্লাউড প্ল্যাটফর্মে কাজ করেন। তিনি ডেভেলপার ও সফটওয়্যার কোম্পানির জন্য বিভিন্ন ক্লাউডসের টুলস বানান; যা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি সহজে প্রডাক্ট লঞ্চ করতে পারে। মূলত তাদের বড় ক্লায়েন্ট বিএমডব্লিউ। সুজা তাদের একটি অটোমেশন টুলস বানিয়ে দেন, যেখানে তারা ডাটা দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যামাজন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে। সেখান থেকে তারা যে অ্যানালাইসিস চালাতে চায়, সেটি সেখানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে যায়। মানে প্রতিষ্ঠান যেভাবে চায় সেভাবেই ফল পেতে পারে অ্যামাজনের কাছ থেকে।
আগামীর স্বপ্ন
সুজা স্বপ্ন দেখেন তাঁর পথ ধরে দেশের তরুণরা বিশ্বের নামি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নেবেন। সেই সঙ্গে উজ্জ্বল করবেন দেশের নাম। দেশের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ূন না কেন, যে কেউ চাইলে তাঁর যোগ্যতা দিয়ে ভালো অবস্থান তৈরি করে নিতে পারেন। এমন বিশ্বাস সালাউদ্দিন আহমেদ সুজার মতো আমাদেরও।
মন্তব্য করুন