দেশভাগের সময় দাদা ফজলুর রহমান ভারতের বিহার থেকে পাড়ি জমিয়েছিলেন এ দেশে। দাদাও সেখানে এই কম্বল বোনার কাজই করতেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জে আসার পর তাঁর দাদার হাত ধরে ১০-১৫টি পরিবার এ কাজে এসেছিল। ধীরে ধীরে তারা পেশা ছেড়ে দিয়েছে। খালেকের বাবা একরামুল হকও এই পেশায় ছিলেন। তাঁর কাছেই খালেকের হাতেখড়ি। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এখন তাঁর বয়স ৬৫। প্রায় ৫০ বছর ধরে কম্বল বানাচ্ছেন। দুই ছেলে, এক মেয়ের বাবা। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে দুটিও চলে গেছে অন্য পেশায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের অদূরে নয়াগোলা গ্রাম। সেই গ্রামে গিয়ে খালেকের বাড়ি চিনতে কারও সমস্যা হবে না। এলাকার মানুষ তাঁর দাদার নাম পর্যন্ত মনে রেখেছেন। বাড়ির ওপরে টিন, দেয়ালে ইটের গাঁথুনি আর মেঝে মাটির। উঠানের এক কোণে রান্নাঘরের পাশে তাঁর তাঁত মেলার জায়গা। তাঁতখানি গোটানো। বললেন, 'সরকার আইগিয়্যা (এগিয়ে) না আসলে হামি আর পারনু না। একজন চাইপ্যা-চিপ্যা (জোর করলে) ধরলে শেষ কম্বলটা বুনছি।' এ জন্য ভেড়ার লোম কেটে এনেছেন বলে বস্তা থেকে লোম বের করে দেখালেন।
শুরুর দিকে রাজশাহীর ক্ষিতীশ বাবুর কাছে কম্বল বিক্রি করতেন খালেক। ওই কম্বলের ওপর ক্ষিতীশ বাবু নিজে নকশা করতেন। এই ক্ষিতীশ বাবুই একদিন তাঁকে সঙ্গে করে ঢাকায় আড়ংয়ে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর থেকে খালেক নিজেই আড়ংয়ে কম্বল দিতেন। সেখান থেকে ঢাকার আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কম্বল সরবরাহ করতেন। ঢাকার আদাবরের 'হ্যান্ড টাচ' ও 'অরণ্য' তাঁর কম্বল নিত।
২০ বছর আগে নয়াগোলা মহল্লায় ১৫-২০ জন এ পেশায় ছিলেন। তখন ভেড়ার সংখ্যা ছিল কম। প্রচণ্ড কষ্টের এ কাজ করার পর পারিশ্রমিকও ছিল কম। তাই শুরুতে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায়, যেখানে বেশি শীত পড়ে, সেখানে ফেরি করে কম্বল বিক্রি করতেন আব্দুল খালেক। ভেড়ার তৈরি কম্বলের উষ্ণতা বেশি হওয়ায় এসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এর চাহিদা ছিল বেশি।
ওই এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ সাইদুর জানান, আগে কম্বলের দাম কম ছিল। পাইকাররা অনেক কম দামে কিনে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি করতেন। পরিশ্রমের মূল্য না থাকায় তাঁরা পেশাটি একে একে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। খালেকের পাশের বাড়ির এ পেশা ছেড়ে দেওয়া অপর তাঁতি আশরাফুল ইসলাম জানান, তিনি ১০ বছর আগেই এ পেশাটি ছেড়ে এখন একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তিনি আরও বলেন, 'আগে চাহিদা থাকলেও দাম না থাকায় বিক্রিতে অনীহা ছিল। আর এখন সরবরাহ কম, যে কয়টা তৈরি হয় ক্রেতারা বাসা থেকেই এসে নিয়ে যান। দামও বেড়েছে অনেক। প্রতিটি কম্বল বিক্রি হয় ডিজাইন অনুযায়ী ৩ থেকে ৫ হাজার টাকায়।'
একটি কম্বল তৈরি করতে ১২টি ভেড়ার পশম লাগে। ১২টি ভেড়া থেকে প্রায় চার কেজি পশম পাওয়া যায়। সেই পশম পানিতে ধুয়ে শুকানো হলে দুই কেজি পশম অবশিষ্ট থাকে। তা ধুনে তুলা তৈরি করা হয়। এরপর চরকায় কেটে তুলা থেকে সুতা তৈরি হয়। ওই সুতা থেকে হস্তচালিত তাঁতে বুনে কম্বল তৈরি শুরু হয়। একটি কম্বল সাধারণত সোয়া তিন হাত চওড়া ও পাঁচ হাত লম্বা হয়।
আব্দুল খালেক জানান, তাঁতে কম্বল বোনার পর সেটা গরম পানিতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। এরপর কম্বলগুলো তিনি রোদে শুকান। এরপর তা ব্যবহার উপযোগী হয়। গরম পানিতে ভিজিয়ে শুকানো হলে সুতাগুলো বেশি শক্ত হয় এবং কম্বলের বাইরের লোমগুলো ঝরে পড়ে যায়। তিনি আরও জানান, ঢাকার খামারবাড়িতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরেও তিনি ধরনা দিয়েছেন। অনুরোধ জানিয়েছেন একটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে। যেন হাতে-কলমে কাজটা শিখিয়ে যেতে পারেন। সেটা মাস ছয় আগের কথা, কিন্তু এখনও সাড়া মেলেনি। দেশে প্রায় ৪০ লাখ ভেড়া আছে। সব ভেড়ার লোম কাজে লাগানো গেলে তাহলে বছরে আমাদের উৎপাদন প্রায় ১০০ কোটি টাকা বাড়বে। া

বিষয় : ভেড়ার লোমের কম্বল কম্বল বিক্রি

মন্তব্য করুন