- আন্তর্জাতিক
- রবীন্দ্রনাথ হারাইয়া প্রমাণ করিলেন, তিনি হারান নাই
অন্যদৃষ্টি
রবীন্দ্রনাথ হারাইয়া প্রমাণ করিলেন, তিনি হারান নাই

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- বাংলা সাহিত্যজগতে যাঁহার অবদান লইয়া সন্দেহ করিবার অবকাশ কাহারোই নাই; তথাপি তাঁহাকে বারংবার চুরির সম্মুখীন হইতে হইয়াছে অবলীলায়। কখনও-সখনও কেহ বলিয়াছেন, তাঁহার বহু লেখাজোখা অন্যত্র হইতে নিজের করিয়া লইয়াছেন। তাহা সত্ত্বেও তিনি রচনা করিয়াছিলেন নিজস্ব অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাস ও নাটক।
যাহা হউক, তাঁহার মৃত্যুর বহু বৎসর পর অবধি বাঙালির একমাত্র গৌরবের বিষয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলখানা; তাহাও চুরি হইয়াছিল। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ প্রত্যুষে রবীন্দ্রভবন খুলিয়াই সকলের টনক নড়িয়া যায়; বিশ্ব অবগত হয়- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল হারাইয়া গিয়াছে। এহেন চৌর্যবৃত্তি লইয়া সাহিত্য প্রাঙ্গণ ও সাহিত্যপ্রেমীর মানসে চরম অসন্তোষ প্রকাশ পাইলেও তাহার প্রকৃতার্থে বিশেষ সুরাহা অদ্যাবধি হইয়াও হইল না; ঠিক যেন তাঁহারই ছোটগল্পের ন্যায় 'শেষ হয়ে হইল না শেষ'।
রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরি ছিল খোদ কলকাতার ঘটনা। তদন্তে পরবর্তী সময়ে জানা যায়, একজন বাঙালিও এই দুস্কর্মে যুক্ত। এই ঘটনা ঘটিবার কয়েক বৎসর পর বাংলাদেশে ঘটিয়াছে আরও বড়সড় চুরির ঘটনা। এইবার কোনো পদক কিংবা লেখা নয়, বরং চুরি হইয়াছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং!
২০২৩ সালের বইমেলা শুরুর পূর্ব হইতেই নানা রকম তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনায় জর্জরিত ছিল। তন্মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্য 'আদর্শ প্রকাশনী'র স্টল নির্ধারণ। কারণ উক্ত প্রকাশনীর তিনটি বই সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করিতে পারে।
শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হইয়া আদর্শ স্টল পাইলেও উক্ত বই তিনটি ছাড়পত্র পাইল না। তখন অনেকেরই মানসপটে আবার জাগিয়া উঠিল এক প্রশ্ন- তবে কি সোনার বাংলায় সকলের সমানভাবে মতপ্রকাশের অধিকার নাই? এই প্রশ্ন সামনে রাখিয়াই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক বিশাল ভাস্কর্য স্থাপিত হয় রাজু ভাস্কর্যের পার্শ্বেই। তথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুখে সংযুক্ত ছিল স্কচ টেপ এবং তাঁহার হাতে থাকা গীতাঞ্জলিটি ছিল পেরেকবিদ্ধ। অকস্মাৎ স্থাপিত এই রবীন্দ্র ভাস্কর্য যেন আপামর জনসাধারণ ও সংশ্নিষ্ট সকলের হদয় ও চক্ষে অঙ্গুলি দিয়া দেখাইতেছিল- 'ইহাই হইতেছে আমাদিগের বাস্তব পরিস্থিতি। যথায় চাহিলেই সকলে সকল কিছু কহিতে পারে না। চাহিলেই সকলে সকল কিছু লিখিতে পারে না।'
এহেন পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে সকল মানুষের মনে লুক্কায়িত ও অপ্রকাশিত ক্ষোভকে উস্কাইয়া দিতেছিল।
পরিতাপের বিষয়, দুই দিন অতিক্রান্ত না হইতেই প্রত্যুষে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির ১৭ তারিখ সকালে মানুষ দেখিল- ভাস্কর্যের রবীন্দ্রনাথ হাওয়া।
কী আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথ পুনরায় চুরি হইলেন এই বাংলার মানুষ দ্বারাই। এই চুরি লইয়া কোনোরূপ তদন্ত কমিটি গঠিত হউক বা না হউক; মানুষ দেখিল চৌর্যবৃত্তির কারণ-করণ রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িতে পারে নাই। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ভাস্কর্য চুরির মাধ্যমে প্রমাণিত হইল- বাকস্বাধীনতা লইয়া বিগত কয়েক বৎসরে যেই গুঞ্জন জনমনে বারংবার আনাগোনা করিতেছিল, তাহার সত্যতা কোথাও না কোথাও প্রাসঙ্গিক। সম্ভবত, এই ভাস্কর্য চুরির মাধ্যমে আরও একবার চুরি হইল বাকস্বাধীনতার অধিকার। ভাস্কর্য চুরি হইলেও জনগণের প্রতিবাদের ভাষা চুরি হয় নাই। মূক করিতে পারে নাই তাহাদের সরব কণ্ঠ। তাই চুরি যাওয়া ভাস্কর্যের স্থলে টানানো হইল 'গুম হয়ে গেছেন রবীন্দ্রনাথ!' শিরোনামে একখানা বৃহৎ ব্যানার।
বাংলার মানুষ বরাবরই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সরব। বিভিন্ন অন্যায়-অত্যাচার তাহাদের স্কন্ধে সিন্দাবাদের ভূতের ন্যায় চাপিয়া বসিতে চাহিলেও বাংলার মানুষ সহজে তাহাতে নত হয় নাই- ইতিহাস তাহাই প্রমাণ দেয়। অনেক চড়াই-উতরাই পার করিয়া তাহারা বারংবার উচ্চশিরে দাঁড়াইয়াছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
আমরা স্বপ্ন দেখি- একদিন বাংলার মানুষ সেই রাঙা প্রভাতের সাক্ষাৎ পাইবে, যেদিন তাহারা ফিরিয়া পাইবে বাকস্বাধীনতার অধিকার। সেদিন আমরাও দেখিব হয়তো এমন এক রবীন্দ্র-ভাস্কর্য, যাঁহার মুখে থাকিবে না স্কচ টেপের বেড়াজাল; হাতে থাকিবে মতপ্রকাশের অধিকারের উন্মুক্ত পুস্তক।
জোহরা ঝুমু: লেখক
মন্তব্য করুন