ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কত অর্থ খরচ করেছে, তা নিয়ে কৌতূহল সব মানুষের। রাশিয়ার মতো বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে অসম শক্তির ইউক্রেনের টিকে থাকার সঞ্জীবনী মূলত যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের অর্থ ও অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বীরবিক্রমে লড়ছে কিয়েভ। দৃশ্যত সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রটির জন্য রাজকোষ আর অস্ত্রভান্ডার খুলে দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী দেশটি।

যুদ্ধ শুরুর পর এক বছর ধরে সাগরের পানির মতোই অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখনও ক্লান্ত নয় যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির অনেক নাগরিক বলছেন, এই অর্থ তাঁদের কল্যাণে ব্যয় করা উচিত ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহহীনদের জন্য এ টাকা খরচ করা যেত।  

গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া হামলা চালানোর পর দিনই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য প্রথম সামরিক সহায়তা দেয় ৩৫ কোটি ডলার। এরপর আর থামেনি বাইডেন প্রশাসন। যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার প্রাক্কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটিকে আরও সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড অস্টিন বলেছেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য ইউক্রেনের যা প্রয়োজন তা আমরা নিশ্চিত করব’। 

যেমন কথা তেমন কাজ। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রেকর্ড বলছে, কংগ্রেস গত এক বছরে ইউক্রেনের জন্য ১১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য অনুমোদন করেছে। এরই মধ্যে ৭৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য ইউক্রেনে পৌঁছে গেছে।
৭৭ বিলিয়ন ডলার কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। বাংলাদেশ এক বছরে পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স হিসেবে যে অর্থ আয় করে, এটা তার চেয়েও অন্তত ৭ বিলিয়ন ডলার বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের মোট সহায়তার মধ্যে ৬৮ বিলিয়ন যাচ্ছে নিরাপত্তা খাতে, ৩৮ বিলিয়ন অর্থনৈতিক ও মানবিক সহায়তায় এবং আরও ৭ বিলিয়ন অন্যান্য ধরনের সাহায্য।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,  ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কতটা সমর্থন দেওয়া উচিত তা নিয়ে দেশটিতে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। দু’জন সম্ভাব্য রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়ানোর বিরোধিতা করছেন। সার্বিকভাবে ইউক্রেনকে সহায়তা করার পক্ষে আগে ৬০ ভাগ মার্কিন নাগরিকের সমর্থন থাকলেও তা এখন কমে ৪৮ শতাংশে নেমেছে। তবে এখন পর্যন্ত ইউক্রেনে সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে মতানৈক্যের চেয়ে ঐক্যই বেশি। এই অর্থ সহায়তাকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে।

কিয়েল ইনস্টিটিউট বলছে, ইউক্রেনকে এখন পর্যন্ত বিশ্ব যা সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র একাই দিয়েছে তার অর্ধেকের বেশি। এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৫৮ বিলিয়ন এবং বাকি বিশ্ব সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে।

ইউক্রেন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি বড় ধরনের তিনটি যুদ্ধ করেছে। দ্য হিলের তথ্যমতে, এর মধ্যে বহুল আলোচিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে প্রতি বছর ২৭৬ বিলিয়ন ডলার, ইরাক যুদ্ধে ১২০ বিলিয়ন এবং আফগান যুদ্ধে বছরে ১১০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ওয়াশিংটন।

ইউএস নিউজের খবরে বলা হয়েছে,  যুক্তরাষ্ট্রের পর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সহায়তার অঙ্গীকার করেছে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানি। তারা সরাসরি ৬.২ বিলিয়ন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষে ৭.২ বিলিয়ন ডলার দেবে। এরপরের অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্য সরকার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ৮.২ বিলিয়ন ডলার।

পশ্চিমা সামরিক সহায়তা : ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জার্মানি ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে।  বার্লিন অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোকে জার্মান ট্যাঙ্ক পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে। তবে ন্যাটোর কোনো দেশই ইউক্রেনের জঙ্গি বিমান পাঠানোর অনুরোধে এখনও রাজি হয়নি। বিবিসির মতে, এর একটি কারণ পাইলটদের যুদ্ধবিমান পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে অনেক সময় লাগে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে অনেক অর্থ প্রয়োজন হয়। তাছাড়া ন্যাটো দেশগুলো উদ্বিগ্ন, ইউক্রেন তাদের যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালালে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্র ৩১টি আব্রামস ট্যাঙ্ক পাঠাচ্ছে, যুক্তরাজ্য ১৪টি চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাঙ্ক এবং জার্মানি ১৪টি লেপার্ডস-২ ট্যাঙ্ক সরবরাহ করছে। স্পেন বলেছে, তারা তাদের ছয়টি লেপার্ড-২ ট্যাঙ্ক ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে।

ইউক্রেনকে দান করা অনেক সাঁজোয়া যানের মধ্যে স্ট্রাইকার অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি নিশ্চিত করেছে, শিগগির ৯০টি স্ট্রাইকার পাঠানো হবে। স্ট্রাইকার হলো একটি দ্রুত সাঁজোয়া পরিবহন এবং রিকনেসান্স যান, যা শহুরে জটিল যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে ৫৯টি ব্র্যাডলি পদাতিক ফাইটিং পরিবহনও রয়েছে। এগুলো ইরাকে মার্কিন বাহিনী ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে। এটি পদাতিক, হালকা এবং এমনকি ভারী সাঁজোয়া যানগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর।
ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে তারা ইউক্রেনে প্যাট্রিয়ট মিসাইল সিস্টেম পাঠাচ্ছে। এই অত্যাধুনিক সিস্টেমের ব্যাপ্তি ১০০ কিমি। একটি প্যাট্রিয়ট মিসাইলের দাম প্রায় ৩০ লাখ ডলার।  এ ছাড়া  যুক্তরাজ্য স্টারস্ট্রিকসহ বেশ কয়েকটি বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে, যা স্বল্প পরিসরে কম উড়ন্ত বিমান ভূপাতিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এগুলো উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং বেশিরভাগ পাল্টা ব্যবস্থা একে থামাতে পারে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র : যুক্তরাষ্ট্রের একটি এমওয়ান আব্রামস ট্যাঙ্কের ন্যূনতম দাম এক কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত গত মাসে ইউক্রেনে এ ধরনের ৩১টি ট্যাঙ্ক পাঠাতে সম্মত হয়েছে।  একটি হিমার্স রকেট লঞ্চার সিস্টেমের আনুমানিক মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত ইউক্রেনে ২০ টিরও বেশি হিমার্স পাঠিয়েছে। বলা হয়, যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে হিমার্স। এভাবে ৮৫০০ টিরও বেশি জ্যাভেলিন অ্যান্টি আর্মার সিস্টেম, ৫০ হাজারের বেশি অন্যান্য অ্যান্টি-আরমার সিস্টেম এবং গোলাবারুদ,  ১৬০০ টিরও বেশি স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট সিস্টেম, ১৩ হাজার গ্রেনেড লঞ্চার এবং ছোট অস্ত্র,    ক্ষুদ্রাস্ত্রের ১১ কোটি ১০ লাখ রাউন্ডের বেশি গোলাবারুদ, ৭৫ হাজারের বেশি বডি আর্মার এবং হেলমেট সেট, হাজার হাজার নজরদারি ব্যবস্থা ও নাইটভিশন গুগল দিয়েছে।

বিমানবাহিনীর জন্য ৮টি নাসাম সিস্টেম,  ১২টি অ্যাভেঞ্জার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, হক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মিসাইল, লেজার পরিচালিত রকেট সিস্টেম এবং একটি প্যাট্রিয়ট এয়ার ডিফেন্স ব্যাটারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনকে ২০টি এমআই-১৭ হেলিকপ্টার, ৭০০ টিরও বেশি সশস্ত্র সুইচব্লেড ড্রোন,  ১৮০০টি সশস্ত্র ফিনিক্স ঘোস্ট ড্রোন, ভ্যাম্পায়ার কাউন্টার-মনুষ্যবিহীন এরিয়াল সিস্টেম, উপকূলীয় প্রতিরক্ষার জন্য ২টি হারপুন উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ৫৮টি উপকূলীয় এবং নদীপথের টহল নৌকা, মনুষ্যবিহীন উপকূলীয় প্রতিরক্ষা জাহাজ এবং আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য রিম-৭ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে মার্কিন সরকার। 

এই তালিকা আরও অনেক দীর্ঘ। বস্তুত, ইউক্রেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের গুদাম । যুক্তরাষ্ট্র দেশটিকে এত সমরাস্ত্র দিয়েছে যে এখন তার নিজের ভান্ডারেই টান পড়েছে।  প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র কেন এত সহায়তা দিচ্ছে ইউক্রেনকে?
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রাক্তন সিনিয়র উপদেষ্টা বিশপ গ্যারিসন এর এক ধরনের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য একটি বিনিয়োগ যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে সমর্থন করে।’ গ্যারিসন বলেন, ‘আমরা যদি ইউক্রেনের মতো মিত্রদের সাহায্য না করি, তাহলে আমাদের নিজেদের কৌশলগত স্বার্থকে বিপদে ফেলার ঝুঁকি নিতে যাচ্ছি’।