ছবির মতো সাজানো-গোছানো পাহাড়ঘেরা এক জনপদ। নির্মল পরিবেশ। রয়েছে আপেল, নাশপাতিসহ নানা ফলমূলের সমারোহ। মূল সড়ক পিচঢালা হলেও পাহাড়ের পাদদেশ কিংবা ওপরে বিশেষ আকৃতির ঘরগুলোতে যেতে হয় মাটির সরু পথ ধরেই। আজারবাইজানের দক্ষিণের টালিশ পর্বতমালার লেরিক অঞ্চলের চিত্রটি এমনই। এখানকার বাসিন্দা শিরালি মুসলুমভ বেঁচেছিলেন ১৬৮ বছর। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও বিশ্বের দীর্ঘজীবী মানব হিসেবে উঠে আসে এই মেষপালকের নাম। মজার ব্যাপার হলো– শিরালি তিনটি বিয়ে করেন। এই তিন পরিবারে সন্তান হয় ২৩ জন। তিনি সবশেষ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ১৩৬ বছর বয়সে। শিরালির মতোই দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন ওই এলাকার আরও অনেকে। তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতেই পাহাড়ঘেরা এলাকাটিতে ১৯৯১ সালে গড়ে তোলা হয় বয়স্ক মানুষের এক বিরল জাদুঘর। সেখানেই সংরক্ষিত আছে এসব তথ্য।

লেরিকের বারজাভু গ্রামের বাসিন্দা শিরালিকে কেউ ডাকতেন ‘শিরালি বাবা’, কেউবা ‘দাদা শিরালি’। একাধিক সূত্রমতে, এই দীর্ঘজীবীর জন্ম ১৮০৫ সালে আর মৃত্যু হয় ১৯৭৩ সালে। তাঁর পাসপোর্টের খসে যাওয়া পাতায়ও সেই তথ্য মেলে, যা সংরক্ষিত আছে ওই জাদুঘরে। দুই কক্ষবিশিষ্ট জাদুঘরের দেয়ালে দেয়ালে বাঁধাই করে রাখা হয়েছে দীর্ঘজীবী মানুষের ছবি। গ্লাসের ভেতর সংরক্ষণ করা হয়েছে তাঁদের ব্যবহৃত বহু পুরোনো নানা আসবাব।

জাদুঘরের তথ্য অনুযায়ী, শিরালি ছাড়াও অঞ্চলটির বাসিন্দা মাহমুদ ইভাজভ বেঁচেছিলেন ১৫০ বছর, মাজিদ আগায়েভ ১৪৫ বছর, গিজিল গুলিয়েভা ১৩৪ বছর।

দীর্ঘ জীবন পাওয়া শিরালির তিন স্ত্রীর মধ্যে একজনের পরিচয় পাওয়া যায় মুক্ত তথ্যভান্ডার উইকিপিডিয়ায়। খাতুম খানুম নামের ওই নারীর জন্ম ১৮৮৪ সালে। তিনি মারা যান স্বামীর মৃত্যুর প্রায় ১১ বছর পরু ১৯৮৮ সালে। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। তবে শিরালি সত্যি সত্যি ১৬৮ বছর বেঁচেছিলেন কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। শিরালির দীর্ঘ জীবনের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচনায় আসে ১৯৬০-এর দশকে।

তাঁর মেয়ে হালিমা কাম্বারোভার বয়স এখন ৯৯ বছর। এখনও সুস্থ জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, তাঁর দাদা বেঁচেছিলেন ১৫০ বছর, ফুফুর বয়স হয়েছিল ১৩০ বছর। তবে তিনি বাবার মতো ১৬৮ বছর না বাঁচলেও দাদা বা ফুফুর মতোই দীর্ঘজীবী হওয়ার আশা করেন।


তিনি জানান, ভোরে ঘুম ভাঙার পর আর তিনি ঘুমান না। সারাদিন তিনি তাঁর বাগানে কিংবা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর ঘরের মেঝেতে বিছানো নরম মোটা কার্পেট। অঞ্চলটির অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, মেঝেতে এভাবে ঘুমানোই শরীরের জন্য ভালো। এখানকার বাসিন্দারা সাধারণ চিকিৎসা আর ওষুধ থেকে সম্পূর্ণ দূরে। তাঁরা প্রাকৃতিক ভেষজ ওষুধের মাধ্যমেই রোগবালাই সারেন। কাম্বারোভা জানান, দীর্ঘ এই জীবনে তিনি কখনও সাধারণ ওষুধ খাননি।

জাদুঘরের তথ্য বলছে, খাদ্যাভ্যাস ছাড়াও অঞ্চলটির বাসিন্দারা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকেন। ভবিষ্যতের জন্য খুব বেশি পরিকল্পনা বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছাড়াই তাঁরা জীবনযাপন করেন। এসবও তাঁদের দীর্ঘ জীবনের রহস্যের অন্যতম।
শিরালির দীর্ঘজীবী হওয়ার ক্ষেত্রে জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাস বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ খাবারই ছিল তাঁর খাদ্য তালিকায়। এর মধ্যে দই, পনির, ভাত অন্যতম। এ ছাড়া তিনি যে মাংস খেতেন, তা পানির বদলে ধোয়া হতো ভেড়ার দুধ দিয়ে। তারপর সেই মাংস সিদ্ধ করে খেতেন তিনি। এখনও অঞ্চলটির বাসিন্দাদের দুগ্ধজাত পণ্যই প্রধান খাবার।

আজারবাইজানের একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফিজিওলজি ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. সেভিঞ্জ হুসেইনোভা বলেন, দীর্ঘজীবী মানুষের নির্দিষ্ট প্রজন্ম আছে। পরিবেশগত দিক ভালো হলে মানব জিনটি হারায় না। এটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারণ করে।
স্পেনের নাভারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি উচ্চতায় বাস করলে হৃদরোগ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায়। কলোরাডো ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের একটি সমীক্ষার তথ্য বলছে, উঁচু জায়গায় বসবাসকারীরা দীর্ঘজীবী হন।

২০১৮ সালের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, গোটা আজারবাইজানে সে সময় ৯০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার। আর ১০০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষ প্রায় সাড়ে ৮০০। এর মধ্যে ৮১৪ জন নারী এবং মাত্র ২৪ জন পুরুষ। দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় ইরান সীমান্তবর্তী পাহাড়ি লেরিক অঞ্চলেই মূলত শতবর্ষী এসব মানুষের বসবাস বেশি।

১৯৯১ সালের আরেক হিসাব বলছে, শুধু লেরিকেই ১০০ বছরের বেশি বয়সী দুই শতাধিক মানুষ ছিলেন। কিন্তু এর পর থেকে কমতে থাকে দীর্ঘজীবীর সংখ্যা। ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১০০ বছরের বেশি বয়সীর সংখ্যা নেমে আসে ১১ জনে। এ জন্য মোবাইল ফোন ও যোগাযোগ টাওয়ারের বিকিরণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করছেন স্থানীয়রা। সূত্র : কাস্পিয়ান নিউজ ও সিএনএন।

বিষয় : জীবন যাপন মানুষ বাঁচে শত বছর

মন্তব্য করুন