
১৯৪৭ সালে বীর বিক্রম মাণিক্যের মৃত্যুর পরপরই ত্রিপুরার রাজপরিবার শিলংয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতাসীন রানী, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নাবালক সন্তান এবং তাঁদের মন্ত্রীরাও একই সঙ্গে যান। মৃত্যুর আগে বীর বিক্রম রাজ্যে বামপন্থিদের মোকাবিলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন তাঁর নাতি প্রদ্যোত দেববর্মা রাজ্যের রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। তিনি সামাজিক মাধ্যমের প্রচারণায় উৎসাহিত ও তরুণ ভোটারদের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে ‘তাঁর লোকদের বাঁচাতে’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ঘটনা কৌতূহলোদ্দীপক। কারণ এবার সেখানে রাজা এবং রাজ্য উভয়েরই প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। ত্রিপুরার নির্বাচনের মাধ্যমে বিজেপির উত্থান এবং বামফ্রন্টের পতনের ঐতিহাসিক ঘটনাও স্পষ্ট।
মানিক সরকারের অধীনে বামফ্রন্ট রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তিকে ধ্বংস করেছে। কিন্তু বিজেপি আদিবাসী পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা-আইপিএফটির মাধ্যমে নতুন জীবন পেয়েছে; তাদের জোট ২০১৮ সালের নির্বাচনে বামফ্রন্টকে পরাজিত করেছিল। এবারও তার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তবে প্রদ্যোত দেববর্মার দল তিপ্রা মোথার উত্থান এবং এর সমর্থক বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি এ বছরের নির্বাচনের ঠিক আগে বিজেপি-আইপিএফটি জোটকে বিচলিত করে তোলে। সে জন্য বিজেপি সতর্কতার সঙ্গে তার আসন ধরে রাখতে কৌশলেই নির্বাচনে নেমেছিল। এমনকি তার জোটের অংশীদার আইপিএফটির সংকট থাকার পরও অবশেষে তারা জয়লাভ করে। তিপ্রা মোথা বিজেপি-আইপিএফটির বিরুদ্ধে পৃথক রাজ্যের দাবিকে জনপ্রিয় করে এবং দাবিটি সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী ভোটারদের একমাত্র ইস্যু হয়ে উঠেছিল। ফলে আশ্চযের্র কিছু নেই যে, লড়াইয়ের জন্য প্রচুর রসদ ও রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের দখলে থাকা সত্ত্বেও বিজেপিকে জেতা নিশ্চিত করতে পি কে জামাতিয়ার হাত ধরতে হয়েছিল, যিনি স্বতন্ত্র রাজ্য তৈরির আন্দোলনে চ্যাম্পিয়ন বলে প্রমাণিত।
ত্রিপুরায় অনুষ্ঠিত গত দুটি নির্বাচনে (বিধানসভা নির্বাচন ২০১৮ ও জেলা পরিষদ নির্বাচন ২০২১) দুটি আঞ্চলিক দল পৃথক রাজ্যের দাবি করে নির্বাচনে ভালো ফল করেছিল।
আইপিএফটি পৃথক তিপ্রা ভূমির দাবি জানিয়ে আসছিল এবং ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। আইপিএফটি বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেছে এবং রাজ্যে ২৫ বছরের সিপিএম শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। বিজেপি-আইপিএফটি জোট ৪২টি আসন জিতেছিল; সিপিএম ১৬টি আসন ধরে রেখেছিল। আইপিএফটি ৯টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ৮টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তপশিলি আদিবাসীদের জন্য ৯টি সংরক্ষিত আসনে বিজেপির জয়ের একটি প্রধান কারণ ছিল আইপিএফটির সমর্থন-ভিত্তি। ২০২১ সালে বৃহত্তর তিপরাল্যান্ডের দাবিতে ত্রিপুরা আদিবাসী প্রগতিশীল আঞ্চলিক জোট (তিপ্রা মোথা) ত্রিপুরা উপজাতীয় অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদে (টিটিএএডিসি) শক্তিশালী অবস্থানে সমীসীন হয় । ত্রিপরা মোথা বিজেপি-আইপিএফটি জোটকে পরাজিত করার পাশাপাশি বামফ্রন্টকেও ধ্বংস করেছে। মজার বিষয় হলো, প্রদ্যোত দেববর্মা তিপ্রা মোথা নির্বাচনের ঠিক আগে গঠন করেছিলেন। তিপ্রা মোথা ১৮টি আসনে জেতে আর বিজেপি-আইপিএফটি জোট ৯টি আসনে জেতে। বিচ্ছিন্নতার যে দাবি উঠছে, তা যেমন বামদের সামরিকীকরণ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের ক্ষমতাচ্যুতির ইতিহাসকে উন্মোচন করে, তেমনি ত্রিপুরার রাজনীতিতে ‘রাজা’র পুনর্জন্ম হয়।
দেববর্মা হলেন ত্রিপুরার শেষ মাণিক্য শাসকের নাতি, যিনি কমিউনিস্ট সংগঠন জনশিক্ষা সমিতির (জেএসএস) ক্রমবর্ধমান শক্তিকে চূর্ণ করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৭ সালে বীর বিক্রম মারা যাওয়ার পর ত্রিপুরার রাজনীতিতে শক্তিশালী হয় জেএসএস ত্রিপুরা। এর পর ত্রিপুরা চলে যায় কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা জেএসএসের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
জেএসএসের নেতারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি ত্রিপুরা জাতীয় গণমুক্তি পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। দলটি পরে অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পাটির্র সঙ্গে একীভূত হয়। গণমুক্তি পরিষদ হিসেবে নিজেকে পুনঃনামকরণ করে এবং সিপিএমের একটি শাখায় পরিণত হয়। মানিক সরকারের অধীনে সিপিএম কেবল মাণিক্য অতীতকে মুছে ফেলারই চেষ্টা করেনি; বরং রাজনৈতিক ইতিহাস থেকেও তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অতীত ও রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে মাণিক্য বামফ্রন্টকে তাড়া করে ফিরে এসেছিলেন।
২০০০ সালের নির্বাচনে ইন্ডেজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব টুইপ্রা (বিজেপির জোট সহযোগী আইপিএফটি এই দলের আইকন) বামফ্রন্টকে পরাজিত করেছিল। ওই নির্বাচন হয়েছিল ভয়ানক সহিংসতা ও জাতিগত উত্তেজনা বৃদ্ধির পটভূমিতে। নিষিদ্ধ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব টুইপ্রা (এনএলএফটি) আদিবাসী কর্মী এবং সিপিএমের নেতাদের ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী অ-উপজাতি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়। প্রতিশোধ হিসেবে ইউনাইটেড বেঙ্গলি লিবারেশন ফ্রন্ট (ইউবিএলএফটি) পুলিশ ও ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলসের (টিএসআর) সহায়তায় আদিবাসী গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়। এটি স্পষ্ট, এনএলএফটির সহিংস প্রচারণায় আইপিএফটি জিতেছিল।
সিপিএম নেতা মানিক সরকার, যিনি এই ঘটনার দুই বছর আগে ১৯৯৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন, তিনি আদিবাসী পরিচয়ের দাবির সঙ্গে দলটিকে দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষের পথে নিয়ে যান। ২০০০ সালে বামফ্রন্ট সরকার আগরতলায় ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভগুলোর নাম পরিবর্তন করতে শুরু করে এবং জনপ্রিয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে ত্রিপুরার আদিবাসী ভাষা কোকবোরোক রোমান লিপিতে লেখার কথা বলে। বস্তুত ২০০১ সালে এর উপজাতি ক্যাডাররা তাদের কোকবোরোক প্রোগ্রামের জন্য বাংলা লিপি ব্যবহার করতে বাধ্য করে। হতাশার বিষয় হলো, এই নেতাদের অনেকেই এখন তিপ্রা মোথার দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। সরকার ২০০০ সালে তিনটি নতুন ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলস (টিএসআর) ব্যাটালিয়ন গড়ে তোলে এবং ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে আরও দুটি ব্যাটালিয়ন যোগ করে। বামফ্রন্ট সরকার দুটি কৌশল অবলম্বন করেছিল: এক. উপজাতীয় বিদ্রোহ দমন করে রাজ্যকে সামরিকীকরণের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। দুই. স্থান ও ঐতিহাসিক স্থানের নাম পরিবর্তন করে বাংলার সঙ্গে ত্রিপুরার ঐতিহাসিক এবং অপরিবর্তনীয় সংযোগে পুনঃবিনিয়োগ করা।
যদিও উপজাতীয় বিদ্রোহ অনেকাংশে দমন করা হয়েছে; কিন্তু দ্বিতীয় কৌশলটির উল্টো ফল হয়েছে। এটি আইপিএফটি এবং কোকবোরোকের জন্য আন্দোলনের মতো অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের উত্থান ঘটায়। তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয় সামনে এনে আদিবাসীদের সংগঠিত করার কাজ করেছিল, সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক স্মৃতি থেকে তাদের উচ্ছেদ ঘটে। বামফ্রন্ট নীতির বিরুদ্ধে এই পাল্টা আন্দোলনের ফসলই তিপ্রা মোথা। ত্রিপুরায় আঞ্চলিক রাজনীতির সঙ্গে বামফ্রন্টের জটিলতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে আদিবাসী বা উপজাতি পরিচয়ের রাজনীতির দিক থেকে। ভারতে বামপন্থিরা সাধারণভাবে পরিচয়ের রাজনীতির প্রতি সন্দেহ পোষণ করলেও অতি ডানপন্থিদের উত্থান এবং শ্রেণি রাজনীতির দুর্বলতা পরিচয়ের রাজনীতির পথ প্রশস্ত করে দেয়। এখানেই সুযোগ পেয়েছে বিজেপি এবং পরিচয়ের রাজনীতিকে তারা কাজে লাগিয়েছে।
আর কে দেববর্মা: চেয়ারপারসন, ইউনিট ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, টিআইএসএস গৌহাটি; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন