- আন্তর্জাতিক
- উত্তরের তিস্তাপাড়ের মানুষ হতাশ, কৃষি নিয়ে শঙ্কা
পশ্চিমবঙ্গে আরও দুই খাল খননের উদ্যোগ
উত্তরের তিস্তাপাড়ের মানুষ হতাশ, কৃষি নিয়ে শঙ্কা

‘বন্যা আর মরুভূমি করি ভারত হামাক মারি ফেলবার চায়। দুঃখ একটাই, দ্যাশ স্বাধীনের ৫২ বছর পার হইল কিন্তু বাঁচি থাকতে তিস্তার পানি চুক্তি দেকি যাবার পাইনো না।’ সম্প্রতি ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত তিস্তা নদীর উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সেচ বিভাগ আরও দুটি খাল খননের উদ্যোগ নেওয়ার খবরে এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা এলাকার ষাটোর্ধ্ব নিজামুল হক।
বছরজুড়ে বন্যা-খরা ও ভাঙনের কবলে পড়া তিস্তা নদীপাড়ের লাখো মানুষ অনেকদিন ধরে ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তির আশায় বুক বেঁধেছিলেন। কিন্তু চুক্তি বহু দূর, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগের কথা শুনে হতাশা ব্যক্ত করেছেন তাঁরা। নদীপাড়ের মানুষরা বলছেন, এমনিতেই শুষ্ক মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলোতে পানিপ্রবাহ থাকে না। ভারতের সঙ্গে চুক্তি না থাকায় পানির ন্যায্য হিস্যাও পাওয়া যায় না। এখন পশ্চিমবঙ্গ যদি তিস্তার উজানে দুটি খাল খনন করে, তাহলে রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুরসহ উত্তরের জেলাগুলোর কৃষি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।
৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি থেকে বাংলাদেশের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর হয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীর ভেতর দিয়ে ১২৪ কিলোমিটার অতিক্রম করে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। হিমালয়ের তুষার গলা আর বৃষ্টিধারায় তিস্তার পানি যতই বেড়ে উঠুক, এখন তা ভারতের হাতে বন্দি। শুধু তিস্তায় পানি না থাকার কারণে উত্তরাঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমার, বুড়িতিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদনদী এবং এর শাখা খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে।গঙ্গাচড়া উপজেলার জয়রামওঝা চরের বাসিন্দা দুলাল মিয়া জানান, আগে থেকে তাঁরা তিস্তার চরে গম, ভুট্টা, কাউন, চীনাবাদাম, আলুসহ বিভিন্ন ফসল ফলাতেন। নদীর পানিতে সেচ সুবিধা থাকায় উৎপাদন খরচ কম হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তিস্তা শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তাঁরা। একই চরের বাসিন্দা মৎস্যজীবী আব্দুস সামাদ, মজিবর ঘাটিয়াল জানান, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি না থাকায় মাছ মিলছে না। ফলে ওই সময় তাঁদের বেকার থাকতে হয়। তাই তাঁরা এখন পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান জানান, তিস্তাপাড়ের পাঁচ জেলার সর্বহারা ২ কোটি মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রাম অনেক দিনের। তিস্তা চুক্তি না হওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্যের মতবিরোধ আর রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ দায়ী।
সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, নীলফামারী ও লালমনিরহাটের সীমান্তবর্তী দোয়ানিতে ১৯৯৮ সালে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প চালু হয়। এ প্রকল্প থেকে ১২ উপজেলার ৬ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বর্তমানে তিস্তায় পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক না থাকায় বাংলাদেশের এই সেচ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে। এখন ভারত সরকার আগের দ্বন্দ্বের মীমাংসা না করে নতুন করে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করল। পশ্চিমবঙ্গ তিস্তার পানি সরাতে কোচবিহার থেকে চ্যাংড়াবান্দা পর্যন্ত দুটি খাল খননের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এতে করে তিস্তা সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উজানে নদীবিষয়ক কোনো কাজ করতে হলে ভাটির দেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু ভারত আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে। এতে বাংলাদেশ ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। নতুন করে আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের তিস্তা প্রকল্পের আওতা বৃদ্ধি করছে। খাল খননের সঙ্গে যুক্ত হবে জলবায়ু পরিবর্তন। এ দুই কারণে বাংলাদেশে পানির প্রাপ্যতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।
মন্তব্য করুন