- আন্তর্জাতিক
- যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই ব্যাংক বন্ধে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা
যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই ব্যাংক বন্ধে বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা

বৈশ্বিক আর্থিক বাজার টালমাটাল। আতঙ্কে বিনিয়োগকারীরা। বাজারমূল্য হারাচ্ছে ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাহকদের মধ্যে। দেশটির বড় ব্যাংকগুলোয় হিসাব স্থানান্তরের হিড়িক পড়ে গেছে। আমানত ও হিসাব স্থানান্তর করায় দেশটির ছোট ও আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। ফলে আরও কয়েকটি ব্যাংক ধসে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর্থিক বাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান মুডি’স আরও ছয়টি ব্যাংকের ঋণমান কমানোর পর্যালোচনা করছে। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রে দুটি ব্যাংক ধসে পড়ার পর থেকেই এসব প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। দ্রুত সমাধানে ব্যর্থ হলে ২০০৭-০৮ সালের সংকটের পুনরাবৃত্তিরও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিরাপদ এবং বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে আশ্বস্ত করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তবে কোনো কিছুই যেন হালে টিকছে না।
মহামারির প্রভাব কমে যাওয়ার পর চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়ে যায়। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ভাঙতে থাকে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়িয়ে যাচ্ছে ফেডারেল রিজার্ভ। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ পদক্ষেপ অনুসরণ করছে অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও। এ অবস্থায় অর্থনীতি মন্দায় পড়তে পারে বলেও সতর্ক করে আসছিলেন বিশ্লেষকরা। এমন পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার বন্ধ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি)। তিন দিনের মাথায় রোববার নিউইয়র্কভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংককেও বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এ দুই ব্যাংকের পতন বৈশ্বিক আর্থিক বাজারকে অস্থিরতায় ফেলে দিয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে জাপান পর্যন্ত পুঁজিবাজারগুলোয় আর্থিক খাতের শেয়ার নিম্নমুখী। সোমবার পর্যন্ত তিন দিনে বিশ্বজুড়ে আর্থিক স্টকগুলো ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বাজারমূল্য হারিয়েছে। এমএসসিআই এশিয়া প্যাসিফিক ফাইন্যান্সিয়াল ইনডেক্স ২ দশমিক ৭ শতাংশ পতন হয়েছে। সূচকটি গত বছরের ২৯ নভেম্বরের পর সর্বনিম্ন। জাপানে মিতসুবিশি ইউএফজে ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের বাজারদর ৮ দশমিক ৩ শতাংশ কমেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার হানা ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ ৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ার এএনজেড গ্রুপ হোল্ডিংসের দরে ২ দশমিক ৮ শতাংশ পতন হয়েছে। এ তথ্য এশীয় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকির বিষয়টিও তুলে ধরছে। গতকাল মঙ্গলবার লেনদেনের শুরুতেও স্টকের পতন অব্যাহত ছিল।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, পরপর দুই ব্যাংক বন্ধের খবরে আমানত নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন মার্কিন নাগরিকরা। এতে ছোট ও আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। পরিবর্তে তাঁরা জেপি মরগান চেজ, ব্যাংক অব আমেরিকা (বিওএ) ও সিটি গ্রুপের মতো বড় ব্যাংকগুলোয় হিসাব স্থানান্তর করছেন। পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে বড় ব্যাংকগুলো নতুন হিসাব খোলার প্রক্রিয়া সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। বিওএসহ বড় ঋণদাতারা নতুন হিসাব খোলা এবং হিসাব স্থানান্তরের অনুরোধগুলো সম্পন্ন করার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে অতিরিক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন। মার্কিন সরকারের এমন জরুরি ব্যবস্থাগুলো আমানতকারীদের অর্থ তুলে নেওয়ার পদক্ষেপ থেকে বিরত রাখতে পারছে না।
আর্থিক খাত স্থিতিশীল করতে জো বাইডেন বলেন, আমেরিকানরা আস্থা রাখতে পারে যে ব্যাংকিং খাত নিরাপদ। যখন আপনার প্রয়োজন হবে, আপনি আমানত তুলতে পারবেন। আমানতকারীরা যাতে অর্থ ফেরত পান, সরকার তা নিশ্চিত করছে। ধসে পড়া সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের আমানতকারীদের জন্য করদাতাদের অর্থ খরচ করা হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। জো বাইডেন আরও বলেন, আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো যে বীমার অর্থ রাখে, সেখান থেকেই গ্রাহকদের আমানত ফেরত দেওয়া হবে। এ সময় তিনি কংগ্রেসের প্রতি আরও কঠোর আইন করার আহ্বান জানান।
ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন গত শুক্রবার আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত সুরক্ষিত করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে হিসাবে এ অঙ্কের বেশি থাকা আমানতগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। যেমন বন্ধ হওয়া এসভিবিতে মোট হিসাবের ৮৫ শতাংশই আড়াই লাখ ডলারের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যাংকেই বীমাসীমার ওপরে বিপুল পরিমাণ আমানত রয়েছে। অরক্ষিত এসব আমানতই তুলে নিতে চাচ্ছেন নাগরিকরা। ফলে সবচেয়ে বেশি অস্থিরতায় পড়েছে ছোট ও আঞ্চলিক ব্যাংকগুলো।
এসভিবি পতনের পরিপ্রেক্ষিতে মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস আরও ছয়টি মার্কিন ব্যাংকের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দেওয়ার বিষয় পর্যালোচনায় রেখেছে। এর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিগনেচার ব্যাংকের রেটিং জাঙ্ক স্ট্যাটাস বা টেরিটরিতে (ঋণ পরিশোধে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ) নামিয়ে আনে প্রতিষ্ঠানটি। রেটিং কমে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেওয়া কঠিন এবং আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠতে পারে। মুডি’সের পর্যালোচনায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক, জিয়নস, ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্স, কমেরিকা, ইউএমবি ফাইন্যান্সিয়াল ও ইনট্রাস্ট ফাইন্যান্সিয়াল। এ খবরের পর সোমবার ব্যাংকগুলোর শেয়ারদর ১২ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। রেটিং এজেন্সিটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ব্যাংকের অত্যন্ত ভঙ্গুর তহবিল শর্তাবলি বীমাবিহীন আমানতগুলোর বহিঃপ্রবাহের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
সিএনএন জানায়, একের পর এক ব্যাংক বন্ধ ২০০৭-০৮ সালের মন্দার বিষয়টি সামনে এনেছে। ওই সংকটের পুনরাবৃত্তি হওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সে সময় ব্যাংকের সচ্ছলতার প্রতি বিনিয়োগকারীদের অনাস্থা এবং ঋণপ্রাপ্ততা কমে যাওয়ায় মার্কিন পুঁজিবাজারে ধস নেমেছিল। সংকটটি দ্রুতই বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এতে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। ঋণ পাওয়া কঠিন এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হ্রাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে স্থবিরতা তৈরি হয়। ২০১১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি ওই সংকট কাটিয়ে উঠেছিল। এ সংকটের পর আর্থিক নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা হয়েছিল।
তবে সেই পরিস্থিতির চেয়ে এবারের সংকট আলাদা মনে করছেন বেশিরভাগ বিশ্লেষক। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ল স্কুলের করপোরেট ল বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড স্কিল মনে করেন, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় অন্য ব্যাংকগুলোও দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। তা ছাড়া ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়া মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। তবে এ সংকটে এখনও ২০০৭-০৮ সালের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের বর্তমান অবস্থা ভালো হলেও আতঙ্ক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। অনাস্থার কারণে আমানতকারীরা অর্থ তুলে নিতে থাকলে সংকট ভয়াবহ হতে পারে। তবে আশার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা ধীর হয়েছে। গতকাল প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক এক বছর আগের তুলনায় ৬ শতাংশ বেড়েছে। জানুয়ারিতেও বাড়ার হার ৬ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল। ফলে আগামী বৈঠকে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানো চলমান পদক্ষেপের ইতি টানতে পারে। এটি দেশটির বিনিয়োগকারীদের কিছুটা আশাবাদী করে তুলেছে।
কমনওয়েলথ ফাইন্যান্সিয়াল নেটওয়ার্কের প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা ব্র্যাড ম্যাকমিলান বলেন, ২০০৮ সালের তুলনায় পুরো আর্থিক খাতের পদ্ধতি আরও স্বচ্ছ এবং ভিত্তি বেশ শক্তিশালী। ওই সংকটের পর সরকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে এবং সেগুলো মোকাবিলায় ব্যবস্থাপনা তৈরি করে। তবে এর মানে এই নয় যে, সামনে আর কোনো বিপদ নেই।
একটি নোটে নিউইয়র্কভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, আমানত স্থানান্তর বা তুলে নেওয়া ব্যাংকিং খাতের শেয়ারহোল্ডারদের জন্য খারাপ খবর। এটি অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কাকে বাড়িয়ে তুলেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও মাঝেমধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশও। ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানই বন্ধের মুখে পড়তে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ওই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক কী করছেন? তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছেন কিনা। যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ হওয়া ব্যাংক দুটিকে আইনি পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি আমানতকারীদের সুরক্ষিত করা হচ্ছে। আবার দেখেন, আমাদের এখানে যে কোনো ঘটনায় বাজেট থেকে অর্থ দেওয়া হয়। তারা কিন্তু জনগণের করের টাকায় সেটা করবে না। তারা ঠিকই দায়ীদের খুঁজে বের করে আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য করবে। সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ জনগণের আস্থা আরও বাড়িয়ে দেয়। এটাই আমাদের জন্য বড় শিক্ষা।
বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকই ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এখানে জনগণের আস্থা ধরে রাখাটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমাদের দেশের কোনো একটি ব্যাংক বন্ধের মুখে পড়লে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থা ধসে পড়তে পারে। এ জন্য খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা খুব জরুরি। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আমানতকারীদের যেভাবে সুরক্ষার ঘোষণা দিয়েছে, আমাদের কিন্তু সেটা নেই। সেখানে আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত আমানত সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে মাত্র দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফেরত পাওয়ার আশা আছে। এটি বাড়ানোরও সময় এসেছে। এসব পদক্ষেপ গ্রাহকদের আস্থা শক্তিশালী করতে পারে।
মন্তব্য করুন