ভুল নীতির পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি গভীর সংকটে। সংকট থেকে উত্তরণে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ খুব একটা কাজে আসবে না। এতে সরকার হয়তো সাময়িক স্বস্তি পাবে। তবে ঋণের দায় পরিশোধ ও শর্তপূরণে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে। সার্বিক মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি জনগণকে ভোগাবে।

‘আইএমএফ-এর ঋণ: ভোগ করবে কে, পরিশোধ করবে কে?’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। গতকাল শনিবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত এ ওয়েবিনারে বক্তব্য দেন– গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, প্রথম আলোর অনলাইনপ্রধান শওকত হোসেন প্রমুখ।

ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দীর্ঘদিনের ভুল নীতির কারণে অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ। কৃত্রিমভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে আমদানিকারকরা লাভবান হলেও রপ্তানি ব্যাহত হয়েছে। বড় পাঁচ-ছয়টি শিল্পগোষ্ঠীকে সুযোগ করে দিতেই এতদিন এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। তিনি মনে করেন, বর্তমানে অর্থনীতিতে যে সংকট বিরাজ করছে, তা কাটিয়ে উঠতে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বলতে দেশে কিছু নেই। অর্থনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান ব্যক্তি অর্থমন্ত্রী, অথচ কার্যত তিনি অনুপস্থিত। অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দক্ষ লোকদের নিয়ে একটি দল থাকা উচিত। কিন্তু এসবের কিছুই নেই। কত দিনে সংকট সমাধান করা যাবে, তার কোনো রোডম্যাপ কোথাও মিলছে না। বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কিছু কথা বলছেন বটে, তবে তার অনেকটাই বাস্তবসম্মত নয়।

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যবসায়ীরা অধিক মূল্য দিয়ে হলেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি চাচ্ছেন। যা সরকার দিতে পারছে না। আদানি গ্রুপসহ বিদ্যুৎ খাতে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তবে কী চুক্তি হচ্ছে, তা জনগণ জানে না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে গোপন চুক্তি করার অধিকার কি সরকারের আছে– এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, গোপন চুক্তির মাধ্যমে জনগণের টাকা ব্যয় হতে পারে না। জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা না থাকলে শুধু আইএমএফ নয়, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সংস্কার দেশের কোনো কাজে আসবে না।

আইএমএফ ভর্তুকি কমাতে বলে, দুর্নীতি নয়– এমন মন্তব্য করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের ঋণের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ব্যাংক খাত, রাজস্বসহ অন্যান্য সংস্কারের কথা আইএমএএফ বলে থাকে। তবে সেগুলো বাস্তবায়ন না হলেও ঋণের কিস্তি বন্ধ হয় না। কিন্তু ভর্তুকি কমানোর নামে জ্বালানি, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি তারা খুব কঠোরভাবে মনিটর করে। আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণে গত তিন মাসে তিন দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। যার প্রভাবে সরকারি হিসাবেই গত ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে, যা ভোগাবে ভোক্তাকে। কিন্তু যেসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ অবস্থা, তা নিয়ন্ত্রণে এরা আগ্রহ দেখায় না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, পাঁচ বছর পরপর যদি জনগণের কাছে যেতে হতো, তাহলে সরকার জনগণের কল্যাণে কাজ করত। ভোটের অধিকার হরণের ফলে জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা ভঙ্গ হয়েছে। এতে বিদ্যুতে দাম কতবার বাড়ল, এতে সরকারের কিছু যায় আসে না। ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রভাবশালীদের বিষয়ে সরকার কিছু করে না।

সাংবাদিক শওকত হোসেন বলেন, বড় ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যায় এমন সংস্কার সরকার করতে পারে না। কিন্তু আইএমএফের শর্ত পূরণে ভর্তুকি কমানোর মতো বিষয়গুলো সহজেই বাস্তবায়ন করে।