ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

বেইজিং-মস্কো আরও কাছাকাছি

আন্তর্জাতিক

বেইজিং-মস্কো আরও কাছাকাছি

চীনের প্রেসিডেন্ট শিজিনপিংয়ের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীনের বেইজিং-এ।

জেফ পাও

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৩ | ২১:১২

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আজ মস্কো যাচ্ছেন। সেখানে ২২ মার্চ পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হবে। এই সফরের লক্ষ্য চীন-রাশিয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে একটি সমাধান খোঁজা। কাকতালীয় কিনা জানি না, বৈঠকটি এমন সময়ে হতে যাচ্ছে, যখন কিছু ক্ষেত্রে স্বীয় ইচ্ছার বাইরেই চীন ইউক্রেন যুদ্ধের একটি ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠেছে। এই সপ্তাহে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী সিএনএনকে জানিয়েছে, ইউক্রেনের স্লোভিয়ানস্কে একটি সশস্ত্র চীনা মুগিন-৫ ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে।

অনিচ্ছাকৃত বলার কারণ একটু ব্যাখ্যা করা যাক। জিয়ামেন-ভিত্তিক ড্রোন নির্মাতা মুগিন লিমিটেড অভিযোগ করেছে, তাদের মানববিহীন এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) বা ড্রোন প্রতিষ্ঠানকে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ সেগুলো ‘মানবতার সমৃদ্ধি’র জন্য তৈরি করা হয়েছে। কোম্পানিটি একটি বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা সামরিক উদ্দেশ্যে আমাদের ইউএভি প্রতিষ্ঠান ব্যবহারের নিন্দা জানাই। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ের কাছ থেকে এ বিষয়ে ক্রয়াদেশ গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছি।’ ড্রোনগুলোতে অস্ত্র ও বিস্ফোরক যুক্ত করারও নিন্দা করেছে তারা এবং বলেছে, সামরিক উদ্দেশ্যে বিক্রয়োত্তর পরিষেবা প্রদান করবে না তারা।

ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর মতে, ১১ মার্চ ভোরে একটি মুগিন-৫ ড্রোনকে রাশিয়ান সৈন্যদের দখলকৃত এলাকা থেকে ইউক্রেনের দিকে উড়তে দেখা গেছে। প্রায় ২০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক বহনকারী ড্রোনটি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা একে-৪৭ রাইফেল দিয়ে গুলি করে ভূপাতিত করে। অস্ত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, এটিকে গুপ্তচর ড্রোনের চেয়ে বরং ‘বধির বোমা’ বললে ঠিক বলা হয়। কারণ এতে ক্যামেরা ছিল না। দূর-নিয়ন্ত্রিত কোনো সিগন্যালও এর ওপর কাজ করে না। মুগিন-৫ ড্রোনের ডাক নাম হলো ‘আলিবাবা ড্রোন’। কারণ আলিবাবা ই-কমার্সের প্রতিষ্ঠান তাওবাওতে ড্রোনের প্রতিটি ইউনিট ১৩ হাজার ডলারে পাওয়া যায়।

এর চেয়েও বেশ বড়সড় এক ড্রোনকাণ্ডের পর শি-পুতিন বৈঠকের ঘোষণা দেওয়া হয় : যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন রাশিয়ান দুটি এসইউ-২৭ বিমান দ্বারা আটকানো হয়েছিল এবং মঙ্গলবার সেগুলো কৃষ্ণসাগরে পতিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী বৃহস্পতিবার ৪২ সেকেন্ডের ফুটেজ প্রকাশ করে দেখিয়েছে, রাশিয়ান জেটগুলো ড্রোনের ওপর জ্বালানি ফেলে। বলা আবশ্যক, একটি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোনের দাম প্রায় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এই সপ্তাহে যখন ইউক্রেনের পরিস্থিতি তুঙ্গে ওঠে; চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং বৃহস্পতিবার ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। কিনের বক্তব্যে ইউক্রেনীয় সংকটের মাত্রা বৃদ্ধি এবং এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কায় বেইজিংয়ের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, সব পক্ষের শান্ত, যুক্তিবাদী ও সংযত আচরণ করা উচিত এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফের শান্তি আলোচনা শুরু করা উচিত। তিনি বলেন, চীন যুদ্ধবিরতি, যুদ্ধ বন্ধ, সংকট প্রশমন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে যাবে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রথম বার্ষিকীতে ২৪ ফেব্রুয়ারি বেইজিং ১২ দফার এক বিবৃতি প্রকাশ করে উভয় পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের সংঘাত সমাধানের জন্য সংলাপে বসার আহ্বান জানায়। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি সপ্তাহের শুরুতে মস্কোয় পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর শি জিনপিং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনে কথা বলবেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সমন্বয় ও বাস্তব সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পুতিনের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের গভীর মতবিনিময় হবে।

শুক্রবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘এটি হবে বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তি বজায় রাখার সফর। চীন ইউক্রেনের সংকট বিষয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ ও ন্যায্য অবস্থান বজায় রাখবে এবং শান্তি আলোচনার পক্ষে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।’ তাঁর ভাষায়, ‘জোটনিরপেক্ষ নীতির ভিত্তিতে; সংঘাতমুক্ত এবং তৃতীয় পক্ষের লক্ষ্যে পরিণত না হওয়ার নীতিতে উভয় দেশ প্রকৃত বহুপক্ষীয়তা এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রীকরণের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে বহু মেরুর বিশ্ব গড়ে তুলবে। বিশ্বে সুশাসনের উন্নতি করবে এবং বিশ্বের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবদান রাখবে।’

তিনি বলেন, চীন-রাশিয়ার সহযোগিতা উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ও জবরদস্তি থেকে মুক্ত। চীন অস্ত্র রপ্তানিতে সর্বদা বিচক্ষণ এবং দায়িত্বশীল মনোভাব পোষণ করে আসছে এবং সেগুলোর ব্যবহার ও রপ্তানি আইন ও বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে ওয়াং বলেন, কিছু দেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই অন্য দেশের ওপর একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে সংকট ত্বরান্বিত করেছে। শুক্রবার রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ, পুতিন ও শি এই সপ্তাহে তাঁদের বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন।

রাশিয়ায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ঝং হানহুই শুক্রবার বলেছেন, চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক ধীরে ধীরে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নেওয়া উচিত। বিশেষ করে বিশ্ব যখন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, তখন এটি জরুরি। তাঁর ভাষায়, ‘নতুন যুগে চীন-রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব আরও পরিপক্ব হচ্ছে। বিশেষ করে গত দশকজুড়ে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর এটি আরও জোরালো হয়েছে।’ তিনি বলেছেন, গত বছর দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৯০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। চীনের মেশিনারি, গাড়ি ও যন্ত্রাংশ রাশিয়ায় রপ্তানির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। এই বছরের গত দুই মাসে তা বেড়েছে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ।

এগুলো থেকে স্পষ্ট বলা যায়, বিশেষত পাশ্চাত্যে যাঁরা মনে করছেন, চীন রাশিয়ার কাছ থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, তাঁরা ভুল বলছেন। দু’দেশ বরং পরস্পর আরও কাছাকাছি আসতে চলেছে। সম্ভবত এ কারণেই কিংডাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ঝাং ই লিখেছেন, তিনি কিছু মার্কিন গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত নন, যাঁরা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে চীনকে দুর্বল রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ দেন। ঝাং বলেছেন, ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের সংকটের ফলে বিভক্ত। কারণ অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও ইতালি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিরোধী। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে চীন সম্পর্ক ছিন্ন করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের চীনবিরোধী নীতি পরিবর্তন করবে না। তাঁর ভাষায়, ‘রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন করলে চীন কী পাবে? যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কঠোর প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা, নাকি কঠোর ভৌগোলিক নিয়ন্ত্রণ? চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মনোভাবের ক্ষেত্রে আসলে রাশিয়া কোনো বিষয় নয়; এটি পুরোপুরিই দেশগুলোর স্বার্থ এবং শক্তির ওপর ভিত্তি করে।’

তিনি বলেন, জার্মানির মতো কিছু দেশ চীনের অর্থনৈতিক শক্তি অনুধাবন করেছে এবং তারা চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে না বলে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে। তাই পশ্চিমাদের খুশি করতে চীনের রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কোনো কারণ নেই।

জেফ পাও: এশিয়া টাইমসের সংবাদিক; এশিয়া টাইমস থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আরও পড়ুন

×