- আন্তর্জাতিক
- সুসম্পর্কের ডিভিডেন্ড
সুসম্পর্কের ডিভিডেন্ড

ছবি: ফাইল
পারস্পরিক সহযোগিতায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করিয়া শনিবার বাংলাদেশ-ভারত ডিজেল পাইপলাইন চালু হইল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঐ দিন অপরাহ্ণে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উহা উদ্বোধন করেন। ভারতের আসামের নুমালীগড় রিফাইনারি হইতে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পাইপলাইনে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর ডিপোতে ডিজেল আমদানি করা হইবে।
উদ্বোধনী দিবসে ১ হাজার ৯৩০ টন ডিজেল আসিলেও চুক্তি অনুসারে পাইপলাইনটি দিয়া বাংলাদেশ প্রথম তিন বৎসর বাৎসরিক দুই-আড়াই লক্ষ টন এবং পরবর্তী সময়ে ১০ লক্ষ টন পর্যন্ত ডিজেল আমদানি করিতে পারিবে, যাহা বর্তমানে বাংলাদেশের বাৎসরিক ৪৬ লক্ষ টন ডিজেল চাহিদার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিবেচনায় লইলে বিষয়টি অত্যন্ত স্বস্তিকর।
আমরা জানি, মধ্যপ্রাচ্য বা আরও কোনো দূরের উৎস হইতে জ্বালানি তৈল আমদানি সময়সাপেক্ষ, যাহার কিয়দংশও লাগিবে না নবউদ্বোধিত পাইপলাইনের ক্ষেত্রে। ইহা ব্যতিরেকে জাহাজে করিয়া তৈল আমদানিতে প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগসহ নানাবিধ কারণে একটু হইলেও অনিশ্চয়তা থাকে, যাহা উক্ত পাইপলাইন দূর করিবে। উপরন্তু ব্যয়ের দিক হইতেও পাইপলাইনের তৈল যথেষ্ট সাশ্রয়ী হইবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলিয়াছেন, আন্তর্জাতিক বাজার হইতে প্রতি ব্যারেল ডিজেল আমদানিতে ১১ ডলার প্রিমিয়াম দিতে হইলেও ভারতের ডিজেলে উহা হইবে মাত্র সাড়ে পাঁচ ডলার। আবার অন্যান্য উৎসের ডিজেলের তুলনায় পাইপলাইনের ডিজেল অধিকতর মানসম্মত হইবে বলিয়া পরিবেশ রক্ষায়ও উহা ইতিবাচক ভূমিকা রাখিবে।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন এমন এক সময়ে চালু হইল, যখন বিশেষত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বহু দেশের ন্যায় বাংলাদেশও জ্বালানি সংকটে পড়িয়াছে। এই কারণে একদিকে সক্ষমতা থাকিবার পরও চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ উৎপাদন অনিশ্চিত অবস্থায় রহিয়াছে, আরেকদিকে আসন্ন বোরো মৌসুমে যখন দেশ চাহিদার সিংহভাগ চাল উৎপাদন করে– দেশের সর্বত্র বিশেষত সেচের জন্য পর্যাপ্ত ডিজেল সরবরাহ অনিশ্চিত হইয়া পড়িয়াছে। জানা গিয়াছে, আলোচ্য পাইপলাইন অন্তত দেশের খাদ্যভান্ডার বলিয়া পরিচিত উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ডিজেলের স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করিবে। অনস্বীকার্য, ভারত নিজস্ব চাহিদার অতিরিক্ত ডিজেলই বাংলাদেশের নিকট বিক্রয় করিবে এবং উহার মাধ্যমে দেশটি উল্লেখযোগ্য মুনাফাও অর্জন করিবে।
কিন্তু ইহাও স্মর্তব্য, বর্তমান বিশ্বে বিশেষত জ্বালানি তৈল কৌশলগত পণ্য বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে; পারস্পরিক সুসম্পর্ক না থাকিলে যাহা এক দেশ অন্য দেশের নিকট অতি চড়া মূল্যেও বিক্রয় করে না। এই প্রেক্ষাপটে কেহ উক্ত পাইপলাইনকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘ সুসম্পর্কের ডিভিডেন্ড হিসাবে বর্ণনা করিলে তাহা অত্যুক্তি হইবে না। দুই দেশেই সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করিয়া ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বাড়বাড়ন্ত সত্ত্বেও উভয়ের মধ্যে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর অবকাঠামোগত যোগাযোগ গড়িয়া উঠিয়াছে।
বিদ্যুৎ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতায়ও অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটিয়াছে। আর এই বৃহত্তম প্রতিবেশীর সহিত সুসম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার যে অধিকতর আন্তরিক– উহাও অস্বীকারের অবকাশ নাই। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতবিরোধী তৎপরতায় ব্যবহৃত হইতে না দেওয়া; বিভিন্ন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ কর্তৃক ভারতকে সমর্থন দান; ভারতের মূল ভূখণ্ডের সহিত উত্তর-পূর্ব ভারতের যোগাযোগ রক্ষায় বাংলাদেশের পক্ষ হইতে সহায়তা ইত্যাদি বিষয় তুলিয়া ধরা যাইতে পারে।
আমাদের প্রত্যাশা– এহেন সুসম্পর্কের চর্চা আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, নেপাল-ভুটানের সহিত বাংলাদেশের সহজ যোগাযোগে ভারতের ভুখণ্ড ব্যবহারে অনুমতি প্রদান এবং বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য ভারতে প্রবেশে সকল বাধার অবসান ইত্যাদি ক্ষেত্রেও অব্যাহত থাকিবে। সেই লক্ষ্যে বিশেষ করিয়া ভারত সরকারকে যথেষ্ট তৎপর থাকিতে হইবে বলিয়া আমরা মনে করি।
মন্তব্য করুন