মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি আমেরিকার মনোযোগ যখন ক্রমহ্রাসমান, তখন চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা চুক্তি এক অনন্য কূটনৈতিক পদক্ষেপ। সৌদি আরব ও ইরান যে এই সমঝোতায় রাজি হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। বরং বেশি কৌতূহল উদ্দীপক– বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যে এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ার মতো প্রভাব পেল কীভাবে?

২০১১ সাল থেকে উত্তর আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ সংঘাত ও দ্বন্দ্বের নেপথ্যে রয়েছে সৌদি-ইরানের মধ্যকার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণেই ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয়ের উদ্রেক হয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ২০১৬ সালে এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, দুই দেশের মধ্যে রীতিমতো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থগিত হয়। এই প্রথমবার চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি-ইরান তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে একমত হয়েছে।

সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে– এমনটা মনে করার কারণ নেই। বস্তুত রিয়াদ তার সম্পর্কের বলয় আরও বিস্তৃত করছে। ক্রমে মেরূকরণে আক্রান্ত বৈশ্বিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে একাধিক অংশীদার নিয়ে এগিয়ে চলাই স্বাভাবিক। এ কারণে সৌদি আরবের জন্য চীনকে পাশে টেনে আনা মূলত একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত; আমেরিকা থেকে দূরে সরে আসা এর লক্ষ্য নয়।

চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি আমদানিকারক। চীনের আমদানি করা জ্বালানির প্রায় ৪০ শতাংশই আসে গালফ অঞ্চল থেকে; সমুদ্রপথে। এ অঞ্চলের দুই পরাশক্তি ও জ্বালানি সরবরাহকারী ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বন্দ্বের অবসান বেইজিংয়ের দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতির জন্য জরুরি। একই সঙ্গে গালফ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে চীন এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে। আমেরিকার নাকের ডগায় চীন এ অঞ্চলে তাদের যুগপৎ প্রতিযোগীতে পরিণত হচ্ছে।
পশ্চিমা বিশ্বের অনুযোগ– পশ্চিমাদের প্রভাবিত বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার বিনামূল্যে সুবিধা লাভ করে বেইজিং। একই সঙ্গে ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়েও বেইজিংয়ের অবস্থান অনেকটাই অপরিষ্কার। এই দুই অপবাদের প্রত্যুত্তরে বেইজিং এখন যেখানে সম্ভব সেখানে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখতে আগ্রহী। মধ্যপ্রাচ্য চীনের বিআরআই উদ্যোগের এক অপরিহার্য অংশ। ২০২২ সালে চীন-আরব সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কে ইতোমধ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সৌদি-ইরান সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের ফলে চীন এ অঞ্চলে জ্বালানি ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করতে পারবে। এ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যদি বেইজিং ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত করতে রাজি করাতে পারে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে আপামর শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত করার পথে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলে এ অঞ্চলে বেইজিংয়ের বর্ধমান প্রভাব আন্তর্জাতিক মহল স্বাগতই জানাবে।

ইরান বৈশ্বিক অঙ্গনে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। ঘরোয়া আন্দোলনে জর্জরিত, অবমানিত। কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে ইরান চীনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। এ চুক্তির মাধ্যমে ইরানের বিচ্ছিন্ন অবস্থার অনেকটাই অবসান ঘটবে; ইরানি সরকারের গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরান এক কার্যকরী অংশীদার পাবে। এটা এখনও পরিষ্কার নয়– ইরান তার দীর্ঘমেয়াদি আঞ্চলিক নীতিতে কোনো কার্যকরী পরিবর্তন আনবে কিনা। তবে এ চুক্তি আশীর্বাদরূপেই দেখছে তেহরান। এ বছর ঘরে ও বাইরে কিছু বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তেহরান। এ চুক্তির আবির্ভাব তেহরানের জন্য একটি বিশাল কূটনৈতিক জয়ের বার্তা বহন করে।

ইয়েমেনে সৌদি আরবের চলমান সামরিক অভিযান বন্ধ করা প্রয়োজন রিয়াদের। ইরান সমর্থিত হুতিদের আক্রমণ বন্ধ করাও জরুরি, ইয়েমেনে যাতে নিজের সীমান্তকে সৌদি আরব নিরাপদ রাখতে পারে। সৌদি আরব এখন নিজ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশের উৎকর্ষে মনোনিবেশ করছে, যাতে ভিশন ২০৩০ বাস্তবায়নে কোনো বাধা না আসে। অর্থনৈতিক উৎকর্ষ সাধন ও সামাজিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে চলা সৌদি যুবরাজ সালমানের জন্য দ্বন্দ্ব ও সংঘাত এড়িয়ে সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

চীনের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের এই দহরম-মহরম দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কিছু বার্তা বহন করে। পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গেও পাকিস্তানের, বিশেষ করে সৌদি আরবের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। সুতরাং চীনের প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে বাড়লে পাকিস্তান কিছু সুবিধা অবশ্যই ভোগ করবে। ভারতের অবশ্য শঙ্কিত হওয়া স্বাভাবিক। ইরানের রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়ে ভারতকে আশ্বস্ত করেছেন– চীনের মধ্যস্থতায় চুক্তি হওয়া মানেই সেটা ভারতের জন্য কোনো দুঃসংবাদ নয়। জ্বালানি আমদানির জন্য ইরানের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল ভারত। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বিস্তার পাকিস্তানের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনলেও, ভারতের জন্য দুঃসংবাদ বয়ে আনবে কিনা–সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ভারত ইতোমধ্যে মুসলিমবিদ্বেষী নীতির জন্য সমালোচিত। এমন অবস্থায় ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী চীনের মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তার ভারতের জন্য নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক হবে।

তবে বাংলাদেশের জন্য এ চুক্তির প্রকৃত বাস্তবায়ন অনেক সুবিধা বয়ে আনবে। সৌদি-ইরানের মধ্যে এই মধ্যস্থতায় সহায়ক ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতোমধ্যে চীন, ইরাক এবং ওমানের প্রশংসা করেছেন। সৌদি আরব, ইরান ও চীন– তিন দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মচারীদের আবাসস্থল। এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের অনেক সুবিধা। যেসব দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে কর্মসংস্থান বিঘ্নিত, সেসব দেশেও শান্তি বিরাজ করলে পুনরায় কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা দেখা দেবে।

সাইমন মোহসিন: বিশ্লেষক