আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-আইসিসি গত ১৭ মার্চ ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ এবং শিশুদের ইউক্রেন থেকে অবৈধভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। প্রায় ১৩ মাস আগে ইউক্রেন সরকার এই অভিযোগ করেছিল। একই অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিশনার মারিয়া এলভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধেও। রাশিয়া এ অভিযোগ এরই মধ্যে অস্বীকার করেছে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানাকে ‘জঘন্য’ বলে অভিহিত করেছে।

প্রশ্ন উঠেছে– প্রেসিডেন্ট পুতিনকে গ্রেপ্তার বা বিচারের মুখোমুখি করার সামর্থ্য বা এখতিয়ার কি আইসিসির আছে? রোম চুক্তির মাধ্যমে ২০০২ সালে আইসিসি গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্রে বলা হয়, প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের নিজ দেশের আন্তর্জাতিক অপরাধীদের বিচারকাজ পরিচালনা করা। আইসিসি শুধু তখনই হস্তক্ষেপ করে, যখন একটি রাষ্ট্র এমন অপরাধীর বিরুদ্ধে তদন্তে অস্বীকৃতি জানায় বা অসমর্থ হয়। বিশ্বের ১২৩টি দেশ রোম চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও রাশিয়া এতে স্বাক্ষর করেনি। আবার ইউক্রেন চুক্তিতে সই করলেও আইসিসি অনুমোদন দেয়নি। ফলে রাশিয়ান নেতাকে গ্রেপ্তার বা বিচার করা কোনোটাই আইসিসির জন্য সহজ নয়। রোম চুক্তির অনুচ্ছেদ ৪, ১২ ও ২৫ অনুযায়ী আইসিসি শুধু তার সদস্য রাষ্ট্রে রোম চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী কোনো অপরাধ হলে অপরাধীর বিচার করতে পারে। এ ছাড়া রোম চুক্তির ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ স্পেশাল রেজুলেশন করে আইসিসিকে ক্ষমতা অর্পণ করলে সদস্য রাষ্ট্রের বাইরে হলেও আইসিসি বিচার পরিচালনা করতে পারে।

আইনগত দিক থেকে দেখলে, রুশ নেতা পুতিনকে বিচারের মুখোমুখি করাতে পারবে না আইসিসি। কারণ রাশিয়া এর সদস্য রাষ্ট্র নয়। বড় জোর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আইসিসিকে এ অভিযোগের তদন্ত করতে বলতে পারে। কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। কারণ রাশিয়ার আবার ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা আছে। তাই দ্য হেগের কাঠগড়ায় পুতিন বা মারিয়া বেলোভার হাজির হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।

আইসিসির আসলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাই নেই। আইসিসির কোনো পুলিশ বা নিরাপত্তা কর্মী নেই। কাউকে গ্রেপ্তারে আইসিসিকে সদস্য রাষ্ট্রের সরকারের সহযোগিতার ওপরই নির্ভর করতে হয়। এ ছাড়া অভিযুক্তের উপস্থিতি ছাড়া কোনো শুনানি হয় না আন্তর্জাতিক আদালতে। তাই এটাও আরেকটা বাধা পুতিনকে বিচারের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে। প্রেসিডেন্ট পুতিন শুধু ‘শক্ররাষ্ট্রে’ ভ্রমণ করলেই তাঁকে গ্রেপ্তার ও আইসিসির কাছে হস্তান্তর সম্ভব হতে পারে।

এদিকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা আইসিসির বিচারক ও প্রসিকিউটরদের নামে ফৌজদারি মামলা করেছে রাশিয়ার তদন্ত কমিটি। ২০ মার্চ রাশিয়ার শীর্ষ তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে এ কথা জানানো হয়।  রুশ তদন্ত কমিটি বলছে, পুতিনের পক্ষ থেকে ফৌজদারি দায়বদ্ধতার কোনো ভিত্তি নেই। এর কারণ, ১৯৭৩ সালের জাতিসংঘ কনভেনশনের অধীনে থাকা রাষ্ট্রপ্রধানরা পূর্ণ দায়মুক্তি পেয়ে থাকেন।

এর আগে ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন এক ভাষণে আইসিসিকে একটি মৃত ও অবৈধ আদালত উল্লেখ করে আফগানিস্তানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মার্কিন সেনাদের বিচারের চেষ্টা করলে এ আদালতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দেন। তিনি আরও বলেন, আমেরিকান কোনো নাগরিকের বিচার করার চেষ্টা হলে আইসিসির বিচারক ও আইনজীবীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। উল্টো তাঁদেরই আমেরিকান ফৌজদারি আইনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। আমেরিকান নাগরিকদের বিরুদ্ধে তদন্তে যারা সহায়তা করবে, সেই কোম্পানি, গোষ্ঠী বা দেশকেও এমন পরিণতির শিকার হতে হবে।

বস্তুত ২০০২ সালে আইসিসি গঠনের পর এই আদালত গুটিকয়েক বিচার কার্যক্রম শেষ করতে পেরেছে– সব কয়টি গরিব ও দুর্বল রাষ্ট্রের অপরাধীদের। শক্তিশালী রাষ্ট্রের কোনো অপরাধীর বিচার আইসিসি শুরুই করতে পারেনি। আইসিসির নাকের ডগায় ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো। ইরাকে স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলেও আইসিসি বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। ব্রিটেনেরই করা চিলকট কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণবিধ্বংসী অস্ত্রের উপস্থিতি বিষয়ে টনি ব্লেয়ার ব্রিটেনকে বিভ্রান্ত করেছিলেন। ব্রিটেন আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও ব্রিটিশ সেনাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। 

ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো কয়েক দশক ধরে গণহত্যা চালালেও আইসিসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ইসরায়েল যুগ যুগ ধরে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ চালালেও আইসিসির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেই। শুধু আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র না হওয়ায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের কোনো বিচার করতে পারছে না আইসিসি। শুধু রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নির্বাসিত করার বিচার করছে আইসিসি।

বিশ্বে এমন সন্দেহ তোলার মানুষ কম নেই– পশ্চিমা রাষ্ট্রের ইন্ধনেই আইসিসি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

ব্যারিস্টার সোলায়মান তুষার: ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য; আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক গবেষক