আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-আইসিসি থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে একেবারে উপযুক্ত সময়ে। যেভাবে এটি জারি হয়েছে, তাতে এক ধরনের বিভ্রান্তি দেখা গেছে। একে তো বর্তমান ও সাবেক অন্যান্য নেতার অপকর্ম ও অপরাধে এমন আদেশ দেখা যায়নি বললেই চলে। তার ওপর রাশিয়া আইসিসির সদস্য দেশ নয় বলে তারা আদালতের আদেশ আমলে নিচ্ছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন খুশি সত্ত্বেও এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুই করার নেই।

তবে ২০ বছর পর হলেও বলা প্রয়োজন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং অস্ট্রেলিয়ার সাবেক নেতা জন হাওয়ার্ড কেবল একটি দেশে আক্রমণের জন্য নয় বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিপর্যয়ের জন্যও বেশি দায়ী। অথচ তাঁদের ধরা হয়নি; অপরাধের কোনো বিচার হয়নি। বুশ এখন সময় কাটাচ্ছেন পেইন্টিং করে; ব্লেয়ার ও হাওয়ার্ড জ্ঞান বিতরণে লেকচার দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ‘কোয়ালিশন অব দ্য উইলিং’-এর ইরাকে আগ্রাসন ছিল আন্তর্জাতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে করা এক গুরুতর অপরাধ। অথচ এ বিষয়ে  ওয়াশিংটন, লন্ডন ও ক্যানবেরা কেবল তাদের খলনায়কদের নিন্দা করার কথা বলে। ফলে এটি ১৯৪৬ সালে নুরেমবার্গ যুদ্ধাপরাধের বিচারে দেওয়া আন্তর্জাতিক সামরিক ট্রাইব্যুনালের সেই হতাশাজনক ঘটনাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়। ‘যুদ্ধ মূলত খারাপ জিনিস। এর প্রভাব কেবল যুদ্ধরত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করে। তাই যুদ্ধ শুরু করা শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ নয়; এটি সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ এবং সকল প্রকারের মন্দ বিষয়ের মধ্যে পুঞ্জীভূত।’

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে অগ্রাহ্য করে ইরাক আক্রমণ করা হয়েছে। তারা জাতিসংঘের সনদ লঙ্ঘন করেছিল। ভয়ংকর অসত্য কথা বলেছিল (গণবিধ্বংসী অস্ত্র) এবং সাদ্দাম হোসেনের শাসনকে হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে। এর মধ্যে ব্রিটিশদের কথাও বলতে হবে, ৪৫ ​​মিনিটের মধ্যে রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র চালু করার সাদ্দামের কথিত ক্ষমতা সম্পর্কে তারা যে অভিযোগ করে সেটি অবিস্মরণীয়। টনি ব্লেয়ার যেমন ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিদের কাছে ঘোষণা করেছিলেন– ‘তাঁরা (গোয়েন্দা সংস্থা) এ উপসংহারে পৌঁছেছেন, ইরাকে রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র রয়েছে, সাদ্দাম সেগুলোর উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন, এসব অস্ত্র ব্যবহারে তাঁর সক্রিয় সামরিক পরিকল্পনা রয়েছে, যা তিনি ৪৫ মিনিটের মধ্যে সক্রিয় করতে পারেন।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিশ্চয়ই বিষয়টি ভোলেননি; ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের ঘোষণা দিয়ে তাঁর বক্তৃতায় এ সত্যটিও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই’ ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল। তাঁর ভাষায়, মিথ্যা ‘সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেখা গেছে এবং জাতিসংঘের কর্তাব্যক্তিদের কণ্ঠেও তা ধ্বনিত হয়েছিল। ফলে আমরা মানুষের জীবনের ব্যাপক ক্ষয়, ধ্বংস এবং সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটতে দেখি।’

ইরাক আক্রমণের অব্যবহিত পরই দেশের অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যায়। দেশটি শিয়া, সুন্নি ও কুর্দি– ৩ ভাগে বিভক্ত হয় এবং দখলদার শক্তি দ্বারা শাসিত হয়। পরে সেখানে আসে আইএস বা ইসলামিক স্টেট। আগ্রাসনের পর থেকে সুশীল সমাজ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০১১ সালের নভেম্বরে চার দিনের জন্য কুয়ালালামপুরে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বসে। সেখানে বুশ, ব্লেয়ার ও তাঁদের সহযোগীদের দোষী সাব্যস্ত করার বিষয়টি আলোচিত হয়। মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ কর্তৃক এককভাবে প্রতিষ্ঠিত এই আদালত যথার্থই বলেছেন– ইরাক আক্রমণ ‘আন্তর্জাতিক আইনের কোনো যুক্তিসংগত ব্যাখ্যায়ও ন্যায্য হতে পারে না’ এবং এটি ‘আমাদের এমন একটি বিশ্বে ফিরিয়ে নেওয়ার হুমকি দেয়, যেখানে আইনের শাসনের ওপরে জঙ্গলের আইন প্রাধান্য পায়, যা কেবল ইরাকিদের জন্যই নয় বরং গোটা অঞ্চল ও পুরো বিশ্বের মানবাধিকারের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।’

সিডনিভিত্তিক সার্চ ফাউন্ডেশনও ২০১২ সালে আইসিসিতে একটি অভিযোগ জমা দেয়। তাদের প্রত্যাশা ছিল, সংস্থাটি তদন্ত করে জন হাওয়ার্ডের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি পিটার মারফি একটি অভিযোগ করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন অপরাধের মধ্যে ছিল– আগ্রাসন, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শান্তি বিনষ্টকরণ। প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ হয়েছিল।

দুই দশক পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক ত্যাগ করেনি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের যে আড়াই হাজার সৈন্য মোতায়েন রয়েছে, তাদের খুব শিগগির চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও আফগানিস্তান থেকে ইতোমধ্যে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। ২০২২ সালে বিদায় নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের প্রধান মেরিন জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেঞ্জি বলেছিলেন, ‘আপনি এমন একটি রাষ্ট্রে যেতে চান, যেখানে সেই জাতি ও জাতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমাদের সাহায্য ছাড়াই সরাসরি সহিংস চরমপন্থি হুমকি মোকাবিলা করতে পারে। দুঃখজনক বিষয় হলো, ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ থেকে এ ধরনের সহিংস চরমপন্থি হুমকির ক্ষেত্রে আরও বেশি সহায়তা করেছিল। 

ইরাকের অবস্থা এমন দেশগুলোর জন্য সতর্কবার্তা, যারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন যে কোনো প্রচেষ্টায় যোগ দিতে বা ওয়াশিংটনের অনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে ইচ্ছুক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপজ্জনক হতে পারে, তবে হেনরি কিসিঞ্জার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, দেশটির বন্ধু হওয়া আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

বিনয় ক্যাম্পমার্ক: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির কমনওয়েলথ স্কলার; কাউন্টারপাঞ্চ ডটঅর্গ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক