
কর্ণাটকবাসী বেশ করেছে। আমি হঠাৎ কংগ্রেসের একজন ‘ফ্যান’ হয়ে গেছি বলে এটি বলছি না কিংবা গান্ধীর রাজপরিবারের জন্যও নয়। আমার এটি বলার কারণ– বিজেপির নির্বাচনী প্রচারণায় যে কুৎসিত চিত্র দেখা গেছে, সেটা মনে রাখা এবং তার রেকর্ড রাখা উচিত। বিজেপির কৌশলের কারণে হারাই তাদের প্রাপ্য ছিল। ব্যক্তিগভাবে আমার কাছে ধর্মীয় বিষয় বা হিন্দুত্ববাদের উন্মাদনা সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় নয়। বিজেপির প্রতিটি নির্বাচনী প্রচারণায় এটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তাই এ ধরনের প্রচারণার বিপদ এবং ঘৃণা নিয়ে হাহাকার করার কোনো মানে নেই। এটা এমন বিষয়, যা আমরা সবাই গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং আমার কাছে এটি ছিল, বজরং দলকে বজরং বালির সঙ্গে যুক্ত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা, যা ছিল অসৎ এবং ঘৃণ্য উভয়ই।
গত সপ্তাহের কলামে আমি বলেছি, কংগ্রেস পার্টির ইশতেহারে জিহাদি পপুলার ফ্রন্ট ইন্ডিয়ার (পিএফআই) মতো বজরং দলকে একই বন্ধনীতে রাখা বোকামি ছিল। কারণ, পিএফআই যেভাবে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংস্থা, বজরং দল তেমনটা নয়। তবে বজরং দল এমন অপরাধীদের দ্বারা পূর্ণ; যারা ধর্ষণ, খুন এবং ঘৃণা ছড়ানোর কারণে দোষী সাব্যস্ত। সুতরাং বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের জন্য একে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় হিন্দু দেবতার সঙ্গে যুক্ত করা ভুল ছিল। তবে আমি খুশি যে, চেষ্টাটি ব্যর্থ হয়েছে। হিজাব, হালাল এবং টিপু সুলতানকে বারবার উল্লেখের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু বানানোও ভুল ছিল এবং সেটি ব্যর্থ।
কর্ণাটকের পরাজয় থেকে বিজেপির আরেকটি বার্তা রয়েছে। একটি রাজ্যের নির্বাচনে আপনি যখন প্রধানমন্ত্রীকে আপনার প্রধান প্রচারক বানাবেন এবং গাঁদা ফুলের পাপড়ি দিয়ে সজ্জিত এসইউভি গাড়ির কাফেলায় অবিরাম রোড শোতে পাঠান, তার মানে আপনি গুরুতর ঝুঁকি নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রধান প্রার্থী হলে জয়ের পরিবর্তে পরাজয় এলে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে দায়ী করা যাবে। প্রচারণার প্রথমদিকে আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, বিজেপি কর্ণাটকে হারতে পারে। আমি এটি বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের বক্তৃতার ভিত্তিতেই বলেছি। তাঁরা সেখানে যেসব বক্তৃতা দিয়েছিলেন, প্রায় একই বক্তৃতা তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনেও দিয়েছিলেন এবং আমরা জানি, সেখানকার পরিণতিও ভালো হয়নি। নির্বাচনী সমাবেশগুলোতে ব্যাপক উপস্থিতির কারণে হয়তো তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবেন বলে নিশ্চিত হয়েছেন। কারণ, তাঁরা ‘এমন ভিড় কখনও দেখেননি, এত ভালোবাসা কখনও দেখেননি।’ তাঁদের মনে রাখা উচিত, নির্বাচনের সময় জনসমাগম করা সহজ। কিন্তু যারা সমাবেশে আসবে, তারা আপনাকে ভোট দেবে কিনা– সেই নিশ্চয়তা নেই।
কর্ণাটকে বিজেপির সরকার ছিল ভয়ংকর। দুর্নীতির বিস্তার সেখানে এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, সরকারি প্রকল্প করার জন্য চুক্তিবদ্ধ বিল্ডাররা কয়েক মাস আগে ক্যামেরার সামনে স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের চুক্তির ৪০ শতাংশ কর্মকর্তাদের দিতে বাধ্য হচ্ছেন। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি ছিল। অথচ তাঁদের কিছুই হয়নি। উল্টো নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে বিজেপি নেতারা বলেছিলেন, কংগ্রেসের সময় ৮৫ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়। প্রায় ৪০ বছর আগে রাজীব গান্ধীর একটি বক্তৃতায় এটি উল্লেখ ছিল। তিনি তখন সততার কারণেই স্বীকার করেছিলেন, তাঁর সরকারের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো এতটাই খারাপ যে, এক টাকার মাত্র ১৫ পয়সা সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছেছে। আমি সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর সততায় মুগ্ধ হয়েছি বলে মনে পড়ে।
এটি সত্য যে, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এক সময় বলেছিলেন, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সেরা যুক্তি হলো গড় ভোটারের সঙ্গে পাঁচ মিনিটের কথোপকথন। সেটি এখন আর সত্য নয়। কারণ, গড় ভোটার পরিবর্তিত হয়েছে। তারা ভালোভাবে বোঝে– কেন তার একটি নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেওয়া উচিত বা উচিত নয়। এর মাধ্যমে তিনি হয়তো কেবল রাজনীতিবিদের নয় বরং সংবাদমাধ্যমকেও এগিয়ে রেখেছেন। এই নিবন্ধটি লিখতে বসার আগে খবরের বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে আমি পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করেছি। কর্ণাটকের মূল বিষয়টি আসলে কী, সেটি বোঝার জন্য কিছু স্পষ্ট বিশ্লেষণ আমি খুঁজছিলাম। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এটি শুনে আমি হতাশ হই, কর্ণাটকের লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় কী করার পরিকল্পনা করেছিল এবং অপর সম্প্রদায় কী করতে পারত? আমার পুরোটা সময় শুধু সম্প্রদায়গত সমীকরণ নিয়েই বিশ্লেষণ দেখেছি। একটি রাজ্যে যেখানে ৭৫ শতাংশেরও বেশি সাক্ষরতার হার, সেখানে সম্প্রদায়গত হিসাব কি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ? এটি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে।
কর্ণাটকের ফল আমাকে উল্লসিত করেছে। কারণ, যারা মনে করেছে, বিজেপি মোদির দল হওয়ায় তাঁর জয় নিশ্চিত কিংবা মোদির প্রচারণার কারণে বিজেপির জয় স্বাভাবিক ছিল মনে করেছিল; কর্ণাটকে পরাজয় তাদেরকে বিষয়টি ফের চিন্তা করতে বাধ্য করবে। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নিজেকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে– রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য পথে পথে সপ্তাহ-মাস কাটানো কি বুদ্ধিমানের কাজ? তিনি যখন নিজেকে আঞ্চলিক প্রশাসকের মর্যাদায় অবনমিত করেন, তখন এটি তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, যেমনটি তিনি নিজেও চান না। তাঁর আরও কঠোর সমর্থক এবং তাঁর মুখপাত্ররা জোর দিয়ে বলেছিলেন, শুধু ‘মোদি ম্যাজিক’ই তাঁদের নির্বাচনে জয়ী করবে এবং এই কারণেই তিনি এতটা অক্লান্ত প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কর্ণাটকে তিনি অন্য যে কোনো রাজ্যের নির্বাচনের চেয়ে বেশি প্রচারণায় সময় ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু ম্যাজিক বা জাদু আর কাজ করেনি। এর কারণ সম্ভবত জাদুরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তাবলীন সিং: ভারতীয় কলাম লেখক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন