ডেঙ্গু রোগের অকাল প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সোমবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেই তথ্য দিয়াছেন, উহা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। সচিবালয়ে আহূত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলিয়াছেন, চলতি বৎসরের জানুয়ারি হইতে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮ শতাধিক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হইয়াছিলেন। বিগত বৎসরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৩১০। অর্থাৎ প্রাণঘাতী এ রোগের মৌসুম আরম্ভ হইবার পূর্বেই দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা গত বৎসরের তুলনায় ছয় গুণ অতিক্রম করিয়াছে। যাহা অধিকতর উদ্বেগজনক, গত বৎসর এই সময়ে কোনো ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু না ঘটিলেও এই বৎসরে ইতোমধ্যে ১৩ জনের মৃত্যু ঘটিয়াছে। শুধু মে মাসেই ডেঙ্গুতে অন্তত দুইজন প্রাণ হারাইয়াছেন। সাধারণত এপ্রিল মাসকে ডেঙ্গু মৌসুমের সূচনাকাল ধরা হইলেও অতীতে জুন মাস তথা বাংলাদেশের বর্ষাকালের পূর্বে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হইবার কোনো প্রমাণ নাই। এই কারণেই কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও প্রতিকারে যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ না করিয়া হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া ছিল? বিদ্যমান চিত্র প্রমাণ করিতেছে, ‘ওয়েকআপ কল’ পাইয়া জাগ্রত হইবার সময় উত্তীর্ণ হইয়াছে। যাহাদের জাগিয়া থাকিবার কথা ছিল, তাহাদের ঘুমের অবসরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ইতোমধ্যে শঙ্কাজনক পর্যায়ে চলিয়া গিয়াছে এবং ১৩টি মূল্যবাণ প্রাণ ঝরিয়াও পড়িয়াছে। এখন জরুরি ভিত্তিতে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করিবার বিকল্প নাই।

আমরা জানি, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশকের বিস্তার প্রতিরোধ করিতে পারিলে এই রোগ প্রতিরোধ যদ্রূপ সম্ভবপর, তদ্রূপ সময়মতো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হইলে উপশমও দুরূহ নহে। কিন্তু কর্তৃপক্ষসমূহ যদি উদাসীনই রহিয়া যায়, তাহা হইলে তো সকলই গরল ভেল! আরও হতাশাজনক,  ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অদ্যাবধি এডিসের প্রজনন প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করে নাই। অথচ জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মশক নিধন তাহাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। উপরন্তু ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এখন মশক নিধনের ‘কার্যকর’ পদ্ধতি লইয়া পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এই বিষয়ে দৃশ্যত কিছুই করিতেছে না। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও যে গত বৎসরের ন্যায় এইবার সময়মতো সংশ্লিষ্ট সকলকে রোগটির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে সচেতন করিয়াছে– এমন বলা যাইবে না। চলতি শতাব্দীর সূচনা হইতে প্রতি বৎসর দেশে এই রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটিবার পরও স্বাস্থ্য বিভাগ এবং ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের এহেন উদাসীনতা গ্রহণযোগ্য নহে।

স্মরণ করা যাইতে পারে, দায়িত্বশীল সংস্থাগুলির দায়িত্বহীনতার কারণেই ২০১৯ সালে বিশেষত ঢাকায় ডেঙ্গু মহামারির রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। ঐ বৎসর সরকারি হিসাবেই একদিকে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তের সংখ্যা লক্ষ ছাড়াইয়াছিল, অপরদিকে মৃত্যু ঘটিয়াছিল ১৭৯ মানুষের। ২০২০ সালে করোনা অতিমারির মধ্যে ডেঙ্গুর দাপট কম থাকিলেও পরবর্তী বছরে অন্তত ১০৫ জন এই রোগে প্রাণ হারান। ঐ বৎসর অবশ্য দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে বেশ সক্রিয় ছিল। তবে গত বৎসরের ভর্তি রোগীর হিসাবে দেশে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব ঘটে। হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেন ৬২ সহস্র ৩৮২ জন; আর মৃত্যু ঘটে ২৮১ জনের; ২০১৯ সাল অপেক্ষা অধিক। উল্লেখ্য, গত বৎসরও ডেঙ্গু বিষয়ে দুই সিটি করপোরেশনের অপ্রতুল তৎপরতা প্রশ্নের জন্ম দিয়াছিল। আমরাও এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে উহা লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছিলাম। নাগরিকের উদ্বেগ যে উহাদের স্পর্শ করে নাই– চলতি বৎসরের অবনতিশীল চিত্র তাহা প্রমাণ করিল।

বিলম্বে হইলেও সংশ্লিষ্টদের স্মরণে রাখিতে হইবে– গত বৎসরের ন্যায় এই বৎসরও ডেঙ্গুর প্রকোট ঢাকার বাহিরে বিশেষত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বিস্তার লাভ করিতেছে। এমতাবস্থায় আমাদের প্রত্যাশা, স্বাস্থ্য বিভাগ, তৎসহিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ডেঙ্গু মোকাবিলায় এখনই তৎপর হইবে। তবে প্রতিটি স্বাস্থ্য সংকট সমাধানে জনসাধারণ ও কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তাই সকল উদ্যোগের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করাও গুরুত্বপূর্ণ। নাগরিকগণ যদি স্বীয় বাড়ি বা ফ্ল্যাটে এডিসের প্রজননস্থল ধ্বংস করিবার ব্যাপারে সচেতন হন, তাহা হইলে পরিস্থিতি মোকাবিলা বহুলাংশে সহজ হইবে।