ঢাকা মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

শোকে কাঁদছে ভারত, নিহত ৩০০ ছুঁইছুঁই

উড়িষ্যায় ট্রেন দুর্ঘটনা

শোকে কাঁদছে ভারত, নিহত ৩০০ ছুঁইছুঁই

ভারতের উড়িষ্যায় তিন ট্রেনের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বগি - এএফপি

সমকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৩ | ১৮:০০

ভারতের উড়িষ্যায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় শত শত মানুষের হতাহতের ঘটনায় শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন দেশটির মানুষ। এ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০ ছুঁইছুঁই। আহত হয়েছেন অন্তত ৯০০ জন। নিহতের সংখ্যা চারশর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন। দেশটিতে গত ২০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা এটি।

শুক্রবার উড়িষ্যার বালাশোর জেলায় তিন ট্রেনের সংঘর্ষ ঘটে। এতে অনেক বগি দুমড়ে-মুচড়ে এবং ছিটকে গেছে। দুর্ঘটনার কারণ এখনও স্পষ্ট নয়। তবে সিগন্যালের সমস্যার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনার পর বগিগুলো ছেয়ে যায় রক্তে। গবেষক অনুভব দাস সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করমণ্ডল ট্রেনের শেষ বগিতে ছিলেন। তিনি ‘‌দূর থেকে চিৎকার আর ভয়ংকর শব্দ’ শুনতে পান। ট্রেনটি থেমে যাওয়ার পর তিনি অক্ষত অবস্থায় লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

২৭ বছর বয়সী অনুভব বলেন, ‘আমি রক্তাক্ত দৃশ্য, ছিন্নভিন্ন মৃতদেহ এবং হাত বিচ্ছিন্ন হওয়া এক ব্যক্তিকে দেখেছি। আমি ঘটনাস্থল ছাড়ার আগে মৃতদেহের সংখ্যা গুনে শেষ করতে পারছিলাম না।’ বেঁচে যাওয়া অর্জুন দাসও ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়েন। তিনি বলেছিলেন, ‘আহত ব্যক্তিরা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন। কোচের ভেতরে এবং ট্র্যাকের পাশে সর্বত্র আহতরা পড়ে ছিলেন। আমি সেই দৃশ্যগুলো স্মরণ করতে চাই না।’

প্রথমে কলকাতা থেকে ছেড়ে যাওয়া করমণ্ডল এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়ে কাছে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনে ধাক্কা দেয়। পরে বিপরীত দিক থেকে আসা হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস নামে আরেকটি যাত্রীবাহী ট্রেন করমণ্ডলের লাইনচ্যুত বগিগুলোর ওপর উঠে যায়। করমণ্ডল যাচ্ছিল কলকাতার শালিমার থেকে চেন্নাই। আর হাওড়া সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস বেঙ্গালুরু থেকে হাওড়া যাচ্ছিল।

উদ্ধারকর্মীরা শনিবার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আটকে থাকা জীবিতদের সন্ধান করছেন। গতকালই উদ্ধার কাজ শেষ হয়েছে। করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাস্থলে দেখা গেছে ছোপ ছোপ রক্ত, রক্তমাখা দেহের স্তূপ, এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছেঁড়া জামাকাপড়, খাবার, ব্যাগপত্র আর বাচ্চাদের খেলনা।

ট্রেনের কামরা একটার ওপর আরেকটা উঠে গেছে, কোনোটা উল্টে গেছে। চাকাগুলো ওপরের দিকে। কয়েকটা পাশের নয়ানজুলিতে পড়ে। মালগাড়ির ওপরে উঠে পড়েছে আস্ত একটা ইঞ্জিন। যেন উড়ে গিয়ে ঘাড়ের ওপর চড়ে বসেছে। রেললাইনে সিমেন্টের স্লিপারগুলো ভেঙেচুরে লোহার রড বেরিয়ে গেছে। উপড়ে গেছে বিদ্যুতের খুঁটি।

দুর্ঘটনাস্থলে বগির পাশে সাদা চাদরের নিচে অসংখ্য মৃতদেহ রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ পরপর এই মৃতদেহগুলো গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

উদ্ধার কাজ চলাকালে পড়ে থাকা কাপড় ও দড়ির সাহায্যে টেনে বের করা হয় কয়েকজনকে। দুর্ঘটনায় অনেকেরই হাত বা পা কাটা পড়েছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া কারও কারও জীবন বাঁচানোর জন্য হাত-পা কেটেও বের করতে হয়েছে।

উড়িষ্যা ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সুধাংশু সারঙ্গি বলেন, মৃতের সংখ্যা ২৮৮তে দাঁড়িয়েছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে আরও বেশি হবে, সম্ভবত ৩৮০র কাছাকাছি হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শনিবার হেলিকপ্টারে দুর্ঘটনাস্থলে এবং পরে বালাশোরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাত্রীদের দেখতে যান। তিনি দুর্ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। উড়িষ্যায় এক দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে।

গতকাল বালাশোরে দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে দেখেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এ সময় কথা বলেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের সঙ্গে। রেলকে অবহেলা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ মমতার।

ভারতে রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক। দেশটিতে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ মধ্যে সবচেয়ে খারাপটি ছিল ১৯৮১ সালে। তখন একটি ট্রেন বিহারে সেতু পার হওয়ার সময় লাইনচ্যুত হয় এবং নিচের নদীতে পড়ে যায়। এতে ৮০০ থেকে ১ হাজার লোক মারা যান।

এর পরের বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৯৫ সালে আগ্রার কাছে ফিরোজাবাদে। তখন দুটি এক্সপ্রেস ট্রেনের সংঘর্ষে ৩০০ জনেরও বেশি লোক মারা যান। এর পরের বড় দুর্ঘটনাটি ঘটল এবার। তবে নিহতের সংখ্যায় শেষ পর্যন্ত আগ্রার দুর্ঘটনায়কে ছাড়িয়ে যেতে পারে বালাশোর।

উড়িষ্যা রাজ্যের মুখ্য সচিব প্রদীপ জেনা নিশ্চিত করেছেন, প্রায় ৯০০ আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স এবং সামরিক বাহিনীসহ উদ্ধারকারী দলগুলোকে দুর্ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। দুর্ঘটনাস্থলে ২০০টি অ্যাম্বুলেন্স ও বাসও আহতদের পরিবহনের জন্য মোতায়েন করা হয়েছে।

দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে বাংলাদেশিরা ছিলেন বলে মনে করা হয়। এ রকম কেউ থাকলে তাঁদের তথ্য জানতে একটি হটলাইন চালু করেছে কলকাতায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশন।

উপহাইকমিশন বলেছে, সাধারণত বাংলাদেশিরা চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়া-আসা করতে করমণ্ডল এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশি কোনো নাগরিক দুর্ঘটনাকবলিত ট্রেনে ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে কলকাতায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন রেল কর্তৃপক্ষ ও উড়িষ্যার রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বলে জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

সূত্র: বিবিসি, এএফপি, রয়টার্স ও এনডিটিভি।

আরও পড়ুন

×