- আন্তর্জাতিক
- তিয়েনআনমেন গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি যেভাবে মুছে ফেলছে চীন
তিয়েনআনমেন গণহত্যার ভয়াল স্মৃতি যেভাবে মুছে ফেলছে চীন

তিয়েনআনমেন বিক্ষোভে ১০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ছবি- এএফপি।
১৯৮৯, জুন। বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ার। ছাত্রদের নেতৃত্বে গণতন্ত্রের দাবিতে বিশাল এক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। শক্ত হাতে বিক্ষোভ দমনে চেষ্টা করছে চীনের সরকার। সারি ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেনা ট্যাংক। তার সামনে একা দাঁড়ালেন এক মানুষ। ট্যাংকের সারি সামনে যেতে বাধা দিচ্ছেন তিনি। নিরস্ত্র মানুষটিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারপর তার আর খোঁজ পাওয়া গেল না। ‘চিরতরে দূরে’ চলে গেলেন তিনি, তবু নিজেকে দেননি ভুলতে। সেনা ট্যাংকের সামনে একাকী দাঁড়ানো তার ছবিটি হয়ে উঠল বিক্ষোভের এক প্রতীক।
দুর্নীতি বন্ধ ও গণতন্ত্রের দাবিতে ওই বিক্ষোভে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিকেরা। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশন শুরু করেন বিক্ষোভকারীরা। তারা মাও সেতুংয়ের ছবির সামনে গণতন্ত্রের দেবীর মূর্তি খাড়া করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন কমিউনিস্ট সরকারকে। বিক্ষোভ দমাতে ৩ জুন রাতে সেনা ও ট্যাংক নামে। তিয়েনআনমেন ঘিরে ফেলে ৪ জুন মধ্যরাতে। স্কয়ারের বাইরে সেনাদের নির্বিচার গুলিতে নিহত হন শত শত বিক্ষোভকারী।

তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভ দমনে হত্যাযজ্ঞে কতজনের প্রাণ যায় তার সঠিক হিসাব জানা নেই কারও। ১৯৮৯ সালে জুনের শেষ দিকে চীনের সরকার জানিয়েছিল, বেসামরিক ব্যক্তি ও নিরাপত্তাকর্মী মিলিয়ে বিক্ষোভে ২০০ জন নিহত হন। তবে অনেকের ধারণা, সেখানে কয়েক হাজার মানুষের জীবন গিয়েছিল।
রোববার ছিল তিয়েনআনমেন গণহত্যার ৩৪তম বার্ষিকী। হংকংসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থান করা চীনারা দিনটিকে স্মরণ করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে। তবে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া মানুষগুলোর স্মরণে হংকংয়ে কোনো সভা-সমাবেশ বা আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।
বিক্ষোভের পর এ নিয়ে সব রকমের আলোচনা নিষিদ্ধ করে চীন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই গণহত্যা নিয়ে যেকোনো বক্তব্য বা পোস্ট ইন্টারনেট থেকে নিয়মিত সরিয়ে নেওয়া হয়। চীনের সরকার কঠোরভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই স্কয়ারের সেদিনকার ঘটনা সম্পর্কে তরুণেরা খুব কমই জানে।
বিস্মৃতির অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলছে। হংকংয়ে দেখা গেছে, লাইব্রেরি থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য আছে এমন বই সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, হংকংয়ের সাংবাদিকরা দেখেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে শহরটির পাবলিক লাইব্রেরি ডাটাবেস থেকে তিয়েনআনমেন গণহত্যার সঙ্গে সম্পর্কিত কয়েক ডজন বই ও ডকুমেন্টারি হারিয়ে গেছে।
গত মাসে এক সংবাদ সম্মেলনে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী জন লি বলেন, কপিরাইট লঙ্ঘন করে, বেআইনি বা ‘অস্বাস্থ্যকর ধারণা’ দেয় এমন কোনো বই পাবলিক লাইব্রেরিতে রাখার জন্য সুপারিশ করা উচিত নয়।
চীন তার সুবিধা ও পছন্দমতো ইতিহাস বিকৃত করে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। ডয়েচে ভেলেকে তারা বলেন, ইতিহাসের যেসব অংশ পছন্দ নয়, তা মুছে ফেলতে চায় চীনের সরকার। এটি তারা দীর্ঘ দিন ধরেই করে চলেছে। তিয়েনআনমেন স্কয়ারের গণহত্যা সম্পর্কিত স্মৃতি বা তথ্য মুছে ফেলার এই প্রচেষ্টা তারই ধারাবাহিকতা।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের সহযোগী পরিচালক মায়া ওয়াং বলেন, জনসাধারণের মন থেকে চীন ওই গণহত্যার স্মৃতি শুধু মুছেই ফেলতে চায় না, বরং কীভাবে স্মরণ করবে তা ঠিক করেও দিতে চায়।
কিংস কলেজ লন্ডনের ডিকসন পুন স্কুল অব ল-এর একজন গবেষক এরিক লাই। তিনি বলেন, কমিউনিস্ট শাসনের কবল থেকে মুক্তি পেতে হংকংয়ের মানুষ গণতন্ত্রকে আশীর্বাদ বলে মনে করত।
বছরের পর বছর ধরে হংকংবাসী তিয়েনআনমেন স্কয়ার গণহত্যা স্মরণ করত। এতে চীনা সরকারের প্রতি তাদের গভীর অভিযোগ ও অসন্তোষ প্রতিফলিত হতো। ২০২০ সালে চীন সরকার হংকংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা আইন জারি করে। এরপর থেকে জনসম্মুখে ওই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণ বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, জাতীয় নিরাপত্তা-সম্পর্কিত অভিযোগে হংকংয়ের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়া হয়েছে। চৌ হ্যাং-তুং, লি চেউক-ইয়ান ও আলবার্ট হো-র মতো হংকং অ্যালায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা এক বছরের বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেতাদেরকে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে হংকংয়ের সাধারণ মানুষের জন্য হুমকি ও ভয়ের উদাহরণ তৈরি করা হয়েছে।

কর্তৃপক্ষ এই বার্তা পাঠাতে চায় যে, হংকংয়ের জনগণ যদি ৪ জুন স্মরণে কোনো সমাবেশ করে, একদলীয় শাসনের অবসান চেয়ে স্লোগান দেয় বা ব্যানার দেখায়, তবে তাদের আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী করা হবে।
গণতন্ত্রকামী ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, তিয়েনআনমেনের গণহত্যা চীনের প্রতি মানুষের ঘৃণা তৈরি করেছে। ২০১২ সালে সি চিন পিং ক্ষমতা নেওয়ার পর দেশটিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও কমে যায়।
তবে চীনের ভিন্নমতাবলম্বী, পশ্চিমা বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর বক্তব্যের তোয়াক্কা করে না চীন। চীনা সমাজের ওপর এর প্রভাব খুবই কম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া যেখানে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে, চীন অখণ্ডতা ধরে রেখে উন্নতি করেছে। গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, চীনের সঙ্গে অন্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর এই পার্থক্য তিয়েনআনমেনের ওই ঘটনাই গড়ে দিয়েছে।
/এইচকে/
মন্তব্য করুন