লস অ্যাঞ্জেলেস
কেন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দাবানল
পালিসেডসে সড়কের ধারে দাবানলের আগুন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৫:৩২ | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৫:৪৯
লস অ্যাঞ্জেলেসে গত কয়েক দশক ধরে খরা, এরপর সাম্প্রতিক বছরগুলো ভারী বৃষ্টিপাত, পরে শরৎ ও শীতকালের শুষ্ক পরিস্থিতিতে ফিরে আসা সবই আগুনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। শক্তিশালী স্যান্টা আনা বাতাস গাছপালাগুলো শুকিয়ে ফেলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছে। স্যান্ট আনা বাতাস হলো শক্তিশালী, শীতল, শুষ্ক, ঝড়ো বাতাস যাকে কখনও কখনও ‘ডেভিল উইন্ডস’ও বলা হয়। এই উচ্চচাপ বায়ু যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রেট বেসিন এলাকা যা মূলত নেভাডা, ইউটাহ, আইডাহো ও দক্ষিণ-পূর্ব ওরেগনের উসর মরুভূমি অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে প্রবাহিত হয়।
হলিউডেও প্যালিসেডসের মতো একই রকম বিশৃঙ্খল দৃশ্য দেখা দেয় বৃহস্পতিবার। দাবানলের আগুন ছড়িয়ে পড়লে অনেক রাস্তা যানজটে আটকে যায়। হাজার হাজার মানুষ তখন একসাথে বের হওয়ার চেষ্টা করছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জরুরি পরিস্থিতিতে লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পালানো সহজ নয়। লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তাগুলো সংকীর্ণ, আঁকাবাঁকা যা সেখান থেকে দ্রুত সরে যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
লস অ্যাঞ্জেলেসে অগ্নিনির্বাপণ ও দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করে অলাভজনক সংস্থা ‘মাইসেইফ: এলএ’। এই সংস্থার তথ্য কর্মকর্তা ক্রিস নেভিল বলেন, প্যালিসেডসে আসা-যাওয়ার জন্য খুব বেশি রাস্তা নেই এবং এর ফলে প্রচুর সমস্যা দেখা দিয়েছে, একদম জগাখিচুড়ি অবস্থা। লস অ্যাঞ্জেলেসে অনেক রাস্তাই বেশ আগে তৈরি করা, তখন পরিবারগুলো ছোট গাড়ি ব্যবহার করতো। সে সময়ে পাহাড়ি এসব এলাকায় এখনকার মতো বড় বড় গাড়ি চলতো না।’ তিনি জানান, ঝুঁকি রয়েছে জেনেও মানুষ এমন জায়গায় থাকতে চায় যেখানে তারা প্রকৃতির সংস্পর্শ পাবে। দাবানলও এসব ঝুঁকির একটি অংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে টেকসই উন্নয়নের জন্য কাজ করা সংস্থা ‘বিল্ডস্ট্রং আমেরিকার’ নির্বাহী পরিচালক নাটালি এনক্লেইড বলেছেন, জরুরি অবস্থার কারণে সড়ক নেটওয়ার্ক তীব্র চাপের মুখে পড়েছিল। যখন দশ হাজারেরও বেশি বাসিন্দা তড়িঘড়ি করে একসঙ্গে পালানোর চেষ্টা করেন, তখন প্রধান সড়কগুলোয় তীব্র যানজট দেখা দেয়। এই যানজট উদ্ধারকাজের গতিকে ধীর করে দেয়, যার ফলে আরও বেশি জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার শহরগুলো থেকে লোকজন সরিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ নতুন কিছু নয়।
এনক্লেইড জানান, ২০১৮ সালে ‘ক্যাম্প ফায়ার’ দাবানলে যখন উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার এলাকাগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলো, তখনও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাধা তৈরি হয়। লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা সেসময় বাধার মুখে পড়ে। রাস্তায় পরিত্যক্ত গাড়ির কারণে দমকলকর্মীদের চলাচলে বাধা তৈরি হয়। এবারকার মতো এতো বিশাল দাবানল ঠেকানোর মতো যথেষ্ট সরঞ্জামের অভাব রয়েছে বলেও জানান এনক্লেইড। ‘স্থানীয় সংস্থাগুলো তাদের সীমিত সরঞ্জাম নিলে বিশাল ও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া দাবানল ঠেকাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে,’ বলেন তিনি।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির ফায়ার চিফের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা বলছে, এই দাবানল মোকাবিলার মতো যথেষ্ট দমকলকর্মী তাদের নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তাগুলোয় সাধারণ দিনেও যানজট থাকে। কিন্তু ‘যখন সবাই ভূমিকম্প বা দাবানলের সময় পালানোর চেষ্টা করে তখন একেবারে অন্যরকম পরিস্থিতি দেখা দেয়,’ বলেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার (ইউএসসি) আরবান প্ল্যানিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জিওফ বোয়িং।
লস অ্যাঞ্জেলেসের অনেক রাস্তায় আটকে যাওয়ার মতো কতগুলো পয়েন্ট তৈরি হয়েছে বলেও তিনি জানান। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি ভৌগোলিক পরিস্থিতির কারণে হতে পারে বা নান্দনিকতার কারণেও। বিশেষ করে নিয়ন্ত্রিত আবাসিক এলাকাগুলোয় চলাচলের রাস্তা মূলত একটিই।’ ২০২৪ সালে জিওফ বোয়িং ও তার সহকর্মীরা একটি গবেষণায় দেখেছেন, রাস্তার নেটওয়ার্ক একটি শহরের দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণায় ১৭৮টি দেশের আট হাজার শহরের যান চলাচল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এসব জায়গায় বন্যা, ভূমিকম্প ও পরিকল্পিত হামলার মতো ঘটনাগুলোও যাচাই করা হয়েছে। জিওফ বোয়িং জানান, ভালো সংযোগের মানে হলো প্রতিটি রাস্তার মোড়ে আরো কতগুলো রাস্তা যুক্ত আছে। যেখানে ত্রিমুখী চত্বর আছে বা কেবল একটি পথ খোলা আছে, এরকম সড়ক পথচারীর বিকল্প পথ বেছে নেয়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়।
সঙ্গীত পরিচালক ডেনিস হ্যানিগানের বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারেন, তাকে স্যান্টা মনিকা পাহাড়ের টোপাঙ্গা ক্যানিয়নের বাড়ি থেকে সরে যেতে হবে। আগুন সরাসরি তার বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে। তবে স্যান্টা মনিকা এলাকার প্রধান সমস্যাই হলো সরু ও পুরানো রাস্তা। এই রাস্তাগুলো স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও কাজে আসে না। হ্যানিগান বলছিলেন, ‘আমাদের আসা-যাওয়ার জন্য মাত্র একটাই আধা গ্রামীণ রাস্তা, আর সেটাও পাহাড়ি ও খুব সরু। আমার পাড়ার রাস্তা দেড় লেনের মতো। অনেক সময় দুটি গাড়িও একসঙ্গে যেতে পারে না।’ তিনি বলেন, আগেও এখানে দাবানল হয়েছে। তবে এবারই প্রথম তারা বিভিন্ন রাস্তা শুধু সেই এলাকার বাসিন্দাদের জন্য খোলা রাখছে, অন্যদের আসতে দিচ্ছে না। সমস্যা কোথায় সেটা না দেখে এই নতুন নিয়ম চালু করেছে তারা।’ বলেন তিনি।
দাবানলের সময় এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করা দেওয়া হয় জানিয়ে হ্যানিগান বলেন, যেখানে আমরা থাকি সেখানে বিদ্যুৎ ছাড়া যোগাযোগ করা যায় না। হাজার হাজার মানুষ আগুনের কোনো খবরই জানতে পারে না। হর পরিকল্পনায় এমন সব বিষয় ভাবা দরকার, যা মানুষকে নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে। ক্যালিফোর্নিয়ার পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়াইল্ডল্যান্ড-আরবান ইন্টারফেস ফায়ার ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ফ্রিভাল্টর বরাত দিয়ে বলেন, রাস্তা তৈরি করার সময় সাধারণত দৈনন্দিন ব্যবহারের কথা ভেবে পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু যখন সময় লাগিয়ে ধাপে ধাপে বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন হয়, তখন বোঝা যায় না পুরো নেটওয়ার্কে কীভাবে চাপটা পড়বে। যখন কোনো দুর্যোগ ঘটে, তখনই বোঝা যায় গলদটা কোথায়- তিনি বলেন। এই সমস্যাগুলো সমাধান করাও কঠিন উল্লেখ করে ফ্রিভাল্ট বলেন, ‘ধাপে ধাপে রাস্তা চওড়া করা যায় না। উন্নয়নের চাপের সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন। বড় প্রকল্প হাতে নেয়ার জন্য অর্থ জমাতে সময় লাগে, আর এর মধ্যেই সমস্যা আরও বেড়ে যায়।’
ফ্রিভাল্টের মতে, অতীত থেকে শিক্ষা নিলে বোঝা যায় যে, আগামী কয়েক সপ্তাহ বা মাস মানুষকে অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা বুঝতে পারছি যে আমরা নিজেদের জন্য যে ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছিলাম তা হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অন্তত সেই এলাকাগুলোর বিষয়ে আলোচনা করতে হবে যেগুলো বড় বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। আমরা কি আরও টেকসই কিন্তু অনেক বেশি ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্মাণ করব? নাকি সিদ্ধান্ত নেব যে সেখানে আর উন্নয়ন করা যাবে না? এগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত, কিন্তু আমাদের নিতে হবে। কারণ এমন দুর্যোগ আবার ঘটবে। বিদ্যমান অবকাঠামো ও রাস্তা সংস্কার করা খুব কঠিন ও ব্যয়বহুল, বলেন জিওফ বোয়িং।
তিনি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, একটি রাস্তার নেটওয়ার্কের কয়েকটি মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে পুরো নেটওয়ার্ক সহজেই ভেঙে যেতে পারে। জরুরি অবস্থায় দ্রুত সরিয়ে নেওয়ার জন্য গণপরিবহন উন্নত করা একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, ব্যক্তিগত যানবাহনের পরিবর্তে গণপরিবহন স্বল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষকে সরিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, টরন্টোর গণপরিবহন দুই ঘণ্টার মধ্যে ১৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে সরিয়ে নিতে সক্ষম। ‘লস অ্যাঞ্জেলেসে অনেক বড় বাস নেটওয়ার্ক রয়েছে। কিন্তু এই এই বাসগুলো একই যানজটে আটকে থাকে। আমাদের আলাদা বাস লেন নেই। থাকলে অনেক মানুষ বাসে চড়ত,’ জিওফ বোয়িং বলেন।
২০২৪ সালে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এক গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে যে দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে স্থানীয়দের সরিয়ে নিতে বিশেষ বাস রুট এবং বিনামূল্যে গণপরিবহন অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। গবেষকরা বলেন, উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে এখনও গণপরিবহন ব্যবহারে সাম্য আনা যায়নি। বিশেষত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, বয়স্ক ও নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোর জন্য এই সাম্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বোয়িং মনে করেন, বিনিয়োগ সত্ত্বেও লস অ্যাঞ্জেলেসের কিছু বাসিন্দাকে গণপরিবহন ব্যবহার করানো কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘নিজের গাড়ি চালানো মানে গোপনীয়তা, নিরাপত্তা, সুবিধা ও একটি বিশেষ মনোভাব বজায় রাখা যায় যা কিনা লস অ্যাঞ্জেলেসের জীবনযাত্রার অংশ।’
- বিষয় :
- দাবানল
- যুক্তরাষ্ট্র